গৃহঋণে চড়া সুদ, সিঙ্গেল ডিজিটের নির্দেশনা লঙ্ঘন
নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০১৮-০৭-২২ ০৮:২৭:২৮
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গৃহায়ণ ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ আদায় করছে। সুদের পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে সার্ভিস চার্জ, কমিশনসহ আদায় করছে বিভিন্ন ধরনের ফি। এতেও ঋণের খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে। সার্ভিস চার্জ ও কমিশন বাবদ যে অর্থ আদায় করা হয় সেগুলোর কারণে ঋণের খরচ ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও তিন মাস পর পর সুদের অংক মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করার কারণে বেড়ে যাচ্ছে মূল টাকার পরিমাণ। এতে গ্রাহক নিয়মিত ঋণ শোধ করে এক দুটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেই ঋণের অংক বেড়ে যায়। এ খাতে ঋণের সুদের হার ৯ থেকে ১৬ শতাংশ হলেও বাস্তবে এসব মিলে সুদের হার ১৪ থেকে ২০ শতাংশ পড়ছে। হিসাবের মারপ্যাঁচ করে তারা ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে ওই হারে উচ্চ সুদ আদায়ের কারণে বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কেনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে এ খাতে ঋণ প্রবাহ যেমন কমছে, তেমনি গৃহায়ণ খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গৃহায়ণ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো সুদ ছাড়াও মোট ঋণের ওপর নানা ধরনের সেবার ফি ও কমিশন আরোপ করেছে। এর মধ্যে ঋণ প্রসেসিং ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, যাচাই ফি, মনিটরিং ফি, হিসাব খোলা ও পরিচালনার ফি আদায় করছে। এর মধ্যে ব্যাংক বেদে ঋণ প্রসেস করার জন্য প্রসেসিং ফি ০.৫০ থেকে ১ শতাংশ আদায় করে। অনেক ব্যাংক গৃহায়ণ খাতের ঋণ বাইরের কোন এজেন্সি দিয়ে তদারকি করে। এক্ষেত্রে তারা আলাদা ১ শতাংশ হারে ঋণ তদারকির জন্য ফি বাড়তি আদায় করে। ঋণ দেয়ার আগে কোনো কোনো ব্যাংক জমি বা ফ্ল্যাটের ব্যাপারে আলাদা কোনো এজেন্সি দিয়ে খোঁজ খবর করায়। এক্ষেত্রে মোট ঋণের বিপরীতে ১ থেকে দেড় শতাংশ হারে বাড়তি ফি আদায় করে। এসব কারণে ঋণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে ব্যাংকগুলো সব ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। সরকারি চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক কেবলমাত্র এ খাতের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। অন্য কোনো ব্যাংক এখনও ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনেনি। এ বিষয়ে বেশ কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক করছে যাচ্ছে তাই। ব্যাংকটি গৃহঋণের সুদ নিচ্ছে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণে সুদ কাটছে সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ পর্যন্ত। যা ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ। কয়েক মাস ধরে কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ বহু গ্রাহককে ২ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। গৃহঋণের ক্ষেত্রে যাদের ৯ শতাংশ সুদ ছিল তাদের করেছে ১১ শতাংশ। আর যাদের ১০ শতাংশ সুদ ছিল তাদের করেছে ১২ শতাংশ। কারও করেছে ১৩ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী একসঙ্গে দুই শতাংশ সুদ বাড়াতে পারে না। তবুও ব্যাংকটি তাই করছে। এছাড়া ১ জুলাই থেকে সব ঋণের সুদ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা ছিল। কিন্তু কোনটিই কার্যকর হয়নি। এতে ব্যাংকিং খাতে সুদারোপে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে ব্র্যাক ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংক। ২২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সুদহার নিয়ে প্রতারণা করছে ব্র্যাক ব্যাংক। শুধু ঋণের সুদ নয়, ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) সীমাও লঙ্ঘন করে আসছে ব্যাংকটি। নিকট অতীতে স্প্রেড সীমা ৭ থেকে ১০ শতাংশের নিচে কখনও নামেনি। অথচ এটি ৫ শতাংশের নিচে থাকার নির্দেশনা ছিল। বর্তমানে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার সতর্ক করেছে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে ব্র্যাক ব্যাংকের রিটেইল ব্যাংকিংয়ের প্রধান নাজমুর রহিমের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি মিটিংয়ে থাকার কথা বলে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে কিছুক্ষণ পর কলব্যাক করেন ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জারা মাহবুব। তিনি বলেন, আমাদের কস্ট অব ফান্ড বেশি। তাই সুদের হারও একটু বেশি। প্রতিযোগী ব্যাংকের (ডাচবাংলা, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড) তুলনায় বেশি কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ক্রেডিট কার্ডে তো ওইসব ব্যাংকের সুদের হার আরও বেশি। তিনি বলেন, সুদের হার কিছুটা কমানোর চেষ্টা করা হবে।
সূত্র জানায়, গৃহায়ণ ঋণের বিপরীতে ইস্টার্ন ব্যাংক সাড়ে ১০ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ, সিটি ব্যাংক সাড়ে ১১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ১১ শতাংশ, ইউসিবি ১১ শতাংশ, আইএফআইসি ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক সাড়ে ১১ থেকে ১৩ শতাংশ, লঙ্কাবাংলা ১৪ শতাংশ, আইডিএলসি সাড়ে ১৩ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়া ১১ শতাংশ, ডিবিএইচ ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ১১ থেকে ১২ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ, এবি ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ, আইপিডিসি ১৪ দশমিক ২৫ থেকে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১২ শতাংশ মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১৩ শতাংশ এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক গৃহঋণে ১১ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। তবে এ সময়ে শুধু ডাচবাংলা ব্যাংকের গৃহঋণের সুদেও হার ছিল ৯ শতাংশ। এছাড়া সরকারি খাতের চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এ খাতে সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ গৃহায়ণ ঋণ দান সংস্থাও এ খাতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে এসেছে। তবে এর বিপরীতে নানা সার্ভিস চার্জের কারণে এ হার আরও বেশি পড়ছে।