কাস্টমসের দূনীতি ঠেকাতে দুদকের ২৬ দফা সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০১৮-১১-১৮ ২০:৩০:০২


জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট শাখার দূর্নীতির জায়গা চিহিৃত করে তা প্রতিরোধে ২৬ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দূদক তাদের অনুসন্ধানে এ বিভাগের ১৯টি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করেছে। দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সারোয়ার মাহমুদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। রোববার (১৮ নভেম্বর) দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য  এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে, আয়কর বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে ১৩টি উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ২৩ দফা সুপারিশ করেছিল দুদক। গত ৮ নভেম্বর ওই চিঠি পাঠানো হয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। আয়কর মেলা উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে দুদকেরও অনেক দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে।’ এনবিআরের এমন অবস্থানের মধ্যেই নতুন করে কাস্টমস বিভাগের দুর্নীতি বিষয়ে এমন সুপারিশ করে দুদক।

কাস্টমসে দুর্নীতির উৎস
দুদক বলছে, ‘পণ্য আমদানিতে পণ্যমূল্য অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচ এস কোড, ওজন পরিমাণ, গুণগতমান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা, প্রতারণা এবং একই প্রকার পণ্যের একাধিক চালান প্রস্তুতকরণ কাস্টমস হাউজগুলোর ব্যাপক প্রচলিত অনিয়ম। উচ্চকর আরোপযোগ্য পণ্যসমূহের ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ বা ওজনের চেয়ে কম এবং নিম্ন হারে কর আরোপযোগ্য পণ্যের ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ বা ওজনের চেয়ে বেশি দেখানো হয়। এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে আমদানিকারকের ঘোষণা অনুসারে শুল্কায়নপূর্বক উক্ত পণ্যাদি খালাস করা হয়।’

ওই চিঠিতে দুদক আরও বলেছে, রেয়াত সংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন বা এসআরও’র শর্ত অমান্য এবং আমদানি-নীতি, পরিবেশ নীতি, অন্যান্য বিধি-বিধান ও নীতিমালার শর্ত বা নির্দেশনা ভঙ্গ করে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা হয়ে থাকে। কাস্টমস আইন, ১৯৬৯ এর বিধান অনুসারে আমদানিকৃত পণ্য এবং খালাসকৃত পণ্যের চালানসমূহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায়শই সমন্বয় করা হয় না। আমদানিকৃত মালামাল নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে খালাস না হলে উক্ত মালামাল নিলামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার বিধান থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে যথাসময়ে এ ধরনের নিলাম অনুষ্ঠিত হয় না।

কাস্টমস এর জন্য বিশ্বব্যাপী অটোমেটেড সিস্টেম ফর কাস্টমস ডাটা (অ্যাসাইকোড) পদ্ধতি চালু থাকলেও বাংলাদেশের কাস্টমস বিভাগ সার্বিকভাবে এখনো এটি চালু করতে পারেনি। এ প্রেক্ষিতে কাস্টমস বিভাগের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াগুলো এখনো অস্বচ্ছ এবং সনাতন পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে, যা দুর্নীতির প্রবণতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রফর্মা ইনভয়েস, বিল অব লেডিং, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট এসব গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি আমদানিকারক বা এজেন্সি গুলো কর্তৃক প্রায়শই যথানিয়মে সঠিকভাবে প্রস্তুত করা হয় না। বিশেষত প্রফর্মা ইনভয়েসে আমদানি পণ্যের নাম, বর্ণনা, একক বা পরিমাণ, গুণগতমান, মূল্য ইত্যাদি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় না। এ ধরনের বিচ্যুতিতে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। কাস্টমস হাউজের বহুবিধ বন্ডসমূহের (শতভাগ রফতানি বন্ড বা চামড়া খাতের বন্ড বা আমদানি বিকল্প বন্ড বা কূটনৈতিক বন্ডশিপ বা স্টোরস বন্ড ইত্যাদি) ব্যবস্থাপনা মানসম্মত নয়। এতে বিভিন্ন অনিয়ম, ভোগান্তি, কর ফাঁকি, দুর্নীতি ইত্যাদির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সমজাতীয় বা প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ট্যারিফ কাঠামোর কারণে কাস্টমস সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ, বিরোধ বা মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরী হচ্ছে এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

দুদক বলছে, ‘প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থের অপ্রতুলতা (অপর্যাপ্ত ওজন নির্ধারক বা স্ক্যানিং মেশিন, সিসি ক্যামেরা, ফর্ক লিফ্ট, সমন্বিত স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশন), কাস্টমস এর অন্তঃ ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক (ভ্যাট এবং আয়কর বিভাগ, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে) সমন্বয়ের অভাব, শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ তৎপরতা, গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাব এবং পণ্য খালাসের নিরীক্ষা সম্পাদনে অনীহা প্রভৃতি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। অস্থায়ী আমদানি বিধির আওতায় বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানিকৃত গাড়ি, লজিস্টিক্স ও অন্যান্য পণ্য, বিলম্বিত শুল্ক ব্যবস্থার আওতায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানিকৃত অনুরূপ মালামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং এরূপ প্রক্রিয়ায় আমদানিকৃত কোন কোন মালামাল পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়ে থাকে।’ এছাড়াও চিঠিতে আরও বেশ কিছু উৎসের কথা বলা হয়েছে।’

দুদকের সুপারিশ
দুদকের সুপারিশে বলা হয়েছে ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্ট প্রস্তুত এবং বিল অব এন্ট্রি প্রণয়নের সময় যথাযথ ঘোষণার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। আমদানি- রফতানিতে যথাযথ ঘোষণাভুক্ত উপাত্তগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অনলাইন সিস্টেম এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অ্যাসাইকোড ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মিথ্যা ঘোষণা কেন্দ্রিক দুর্নীতি হ্রাস পাবে।

অবমূল্যায়ন বা অতিমূল্যায়ন প্রবণতা রোধকল্পে ‘ন্যূনতম মূল্য’ সংক্রান্ত বিদ্যমান প্রজ্ঞাপন বাতিল যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। ঘোষিত পণ্যের পরিমাণ বা মূল্য এবং বাস্তব পরিমাণ বা মূল্যের মধ্যে গরমিল পাওয়া গেলে দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, শুল্ক বিভাগের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের অনেক ক্ষেত্রে অবারিত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা রয়েছে। এমন ক্ষমতা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এসেসমেন্ট কার্যক্রম হতে কোন বিল অব এন্ট্রি-কে সাইড লাইনে পাঠাতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণ করার বিধান রাখা প্রয়োজন।

ইন-বন্ড, এক্স-বন্ড এবং পাশবহি’র তথ্যাদি ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ এবং এসব তথ্যের অ্যাসাইকোডের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অডিট কার্যক্রম সম্পাদন করা যেতে পারে। এছাড়াও আর বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অনলাইন কার্যক্রমে জোর দেওয়া হয়েছে।