মনপুরা সিনেমার মতই ঘটে গেল সব
নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০১৮-১১-২৪ ১৫:১৮:৫২
মনপুরার ঢালচরের পুলিশের কাছে আমি এখন জিম্মি। আমাকে জঙ্গি মামলায় ফাঁসিয়ে কাল ভোরেই মনপুরা থেকে কোর্টে চালান করে দেয়া হবে।
জঙ্গি ভেবে সন্দেহের কারণ হচ্ছে, আমার সাথে তাবু, হ্যামোক, পোর্টেবল বালিশ, স্লিপিংব্যাগ এবং একটা ট্রাইপড পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা, সম্পদশূন্য এই চরে আমি কোনো মিশনে এসেছি। মিশন কমপ্লিট হলে দূরে নদীর তীরে গিয়ে তাবু পেতে অবস্থান করবো, কিংবা হ্যামোকে ঝুলে থাকবো।
আচ্ছা, ঢালচর কোথায় সেটা একটু বলি..
মনপুরার ১নং ইউনিয়নে পড়েছে জায়গাটা। মনপুরা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। রামনেওয়াজ নৌঘাট থেকে সিট্রাকে চড়ে সেখানে যেতে হয়। ঘন্টাখানেকের মতো লাগে যেতে। একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই চরে পঞ্চাশটার মতো পরিবার থাকে। চরবাসি সকলেই দারিদ্র্য সীমার বাইরে জীবনযাপন করে।
আসল কথায় আসি,
আমি সম্পূর্ণ একা ঢাকা থেকে লঞ্চে মনপুরায় নামি। কংক্রিটের দূষিত জীবনযাত্রা আমার কাছে অসহ্য হয়ে পড়েছিলো। একটু গ্রামীন পরিবেশের জন্য মনটা কেমন ছটফট করতেছিলো, তা বলার মতো না। আমার কয়েকজন প্রিয়বন্ধু সফরসঙ্গী হওয়ার কথা থাকলেও তারা আগমুহূর্তে বলে দেয়, যাবে না। আমি অামার সিদ্ধান্তে অটল থেকে একাই বেড়িয়ে পড়ি, মনপুরার উদ্দেশ্যে।
মনপুরা ঘুরাকালীন জানতে পারলাম, পাশেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার “ঢালচর”। আমি সময় না নিয়ে ওই দিনই চলে গেলাম চরে। যে বৃদ্ধের আশ্রয়ে ঢালচরে আসলাম, তার নাম আব্দুর রব হাওলাদার। নদীর কোণঘেঁষা তার ছোট্ট টিনের ঘরটাতে তিনি অতিথিরূপ জায়গা দিলেন।
হাওলাদার চাচার দুই নাতী ও এক ছেলের সাথে আমার বেজায় খাতির হয়ে গেলো। দীর্ঘসময় অামরা গল্প করলাম। বলে রাখি, তখন দুপুর ৩টার কাছাকাছি। এরপর কাছেই আরেকটা ঘর থেকে আমার জন্য কাঁচের প্লেট আনা হলো। এবং সেই আধোয়া প্লেটেই হাওলাদার চাচা ভাত বেড়ে দিলেন। আলুর ছালুন দিয়ে মোটা লালচালের কয়েকপ্লেট ভাত আমি তৃপ্তিভরে খেলাম। কারণ, অনেক্ষণ ধরে পেটে কিছুই যায় নি।
খাবার শেষে হ্যামক আর ট্রাইপড নিয়ে, হাওলাদার চাচার ছোট ছেলের সাথে চর দেখতে বেরোলাম। বলাইবাহুল্য, এই চরের ম্যানগ্রোভবন অতি ভয়ানক। অসংখ্য হরিণ সেখানে আছে। দেখাও যায় সচরাচর।
পথেই দেখা হয়ে গেলো, কোমড়ে পিস্তলগোঁজা দারোগা সাহেবের সাথে। তিনি পথ আটকালেন। জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছেন। আমাকে তার সন্দেহজনক মনে হলো। আমি তাকে স্টুডেন্ট আইডিসহ যাবতীয় কাগজপত্র দিলাম। তিনি নকল বলে ফেলে রাখলেন।
মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছি, সেটা শুনে তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেলো। পাশের একজনের দিকে তাকিয়ে দারোগা বল্লেন, “এও মাদ্রাসার ছাত্র। সবদিক দিয়াই মিল অাছে”।
এরই মধ্যে উপস্থিত চরবাসি জড়ো হয়েছে। তাদের সবার কাছেই আমি ভীনদেশী, অপরিচিত। লোকজন কানাকানি করতেছে। চ্যাংড়া কিছু পোলাপান নেগেটিভ কথা বলে দারোগাকে উশকিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাইতেছে। দারোগা সাহেব অমানুষের মতো অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতেছেন আমাকে। আমার আইডিটিতে সম্মানিজনরা না থাকলে আমি গালিগুলি উল্লেখ করতাম।
নানাভাবে বুঝাচ্ছি, আমি শুধু ঘুরতেই এখানে এসেছি। তারা কেউই বিশ্বাস করলো না। অামি বলেছি, হাওলাদার চাচার বাড়িতে তার আশ্রয়েই তিনি আমাকে উঠিয়েছেন। তাও কেউ বিশ্বাস করলো না।
হাওলাদার চাচাকে সবার সামনে আনা হলো। তিনি আবুলবিড়ি টানতে টানতে অাসলেন। দারোগা সাহেব স্বল্পমূল্যের মোবাইলের ক্যামেরা চালু করে একবার আমার দিকে আরেকবার হাওলাদার চাচার সামনে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “চাচা আপনি ওকে চিনেন?” চাচা সমস্ত সত্যকে উপেক্ষা করে ছাফ জানিয়ে দিলেন, “চিনি না, ওই পোলা এই চরে আইসা আমারে কয় কাগু দুগ্গা বাত দিবেন? হেরপর আমি হেরে দুগ্গা বাত দিছি। আর কিছু কৈতাম ফারি না”
আমার কাছে মনে হলো, প্রত্যন্ত এই চরে কোনো মানুষের বসবাস নাই। পুরা চরই অমানুষ দিয়ে ভরা।
পরোক্ষণেই আমি পরিচয়শূন্য অাশ্রয়হীন একজন মানুষে পরিণত হলাম। সবাই অবিশ্বাস করে বলে ফেল্লো, “জঙ্গি টঙ্গি কিছু একটা হৈবো সার! ধৈরা কোটে চালান কৈরা দেন সার!”
ইতিমধ্যে আমার বাসার অবস্থা খুবই খারাপ। অামি ফাঁকে ফাঁকে আমার বড় ভাইকে সবকিছু জানিয়েছি। আমার বাবা অস্থির হয়ে পড়েছেন। মা প্রচণ্ড আবেগপ্রবন। তিনি যে কী পরিমাণ ভেঙে পড়েছেন, তা অামি এই দূরের নির্জন চরে বসেই বুঝতে পারছিলাম। আমার বোনটাও দূরে বসে অামার খবরে কষ্ট পাচ্ছিলো।
পুলিশরা আমাকে ধরে পুলিশফাড়িতে নিয়ে গেলো। সেখানে আমার সমস্ত ব্যগ তন্নতন্ন করে দেখা হলো। প্রথমে যা বল্লাম, তা ছাড়া ব্যগের মধ্যে কিছুই পাওয়া গেলো না। কিন্তু এগুলিই তাদের সন্দেহের প্রধান কারণ। আমার কাছে কেন তাবু থাকবে? কেন গাছে ঝোলার জন্য হ্যামোক থাকবে? তাদের কথা হলো, এগুলি তো জঙ্গিদের কাছে থাকবে।
ঢালচরে জঙ্গি সন্দেহে একজনকে আটক করা হয়েছে সেই মর্মে মনপুরা থানার ওসির কাছে খবর পাঠানো হয়েছে।
অনেক তদবির তালাফির পর শেষপর্যায়ে ১০,০০০ টাকার অর্থমূল্যের (ঘুসে) বিনিময়ে সেখান থেকে আমাকে কড়া নজরদারিতে ছাড়া হয়। আমি কোনোরকম ঘাটে এসে নৌকায় উঠে বসলাম।
সর্বোপরি, সেখানকার মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে আমি আজন্ম কৃতজ্ঞ থাকবো। ঢালচরের এই একটা মানুষ অামাকে চির ঋণী করে রাখলেন। আল্লাহ তাকে হায়াতে তায়্যিবা দান করুক।
চরবাসি! তোমাদের এই আচরণ কোনোদিন ভুলবো না।