সহিংসতার শিকার ৯৭ শতাংশ নারী ‘বিচার’ পান না

নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০১৮-১১-২৭ ০০:২২:৫৫


বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার দুই-তৃতীয়াংশই পারিবারিক সহিসংসতা। আর সহিংসতার শিকার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানীর পর্যায়ে যায় না বা গেলেও বাতিল হয়ে যায়। মাত্র ৩ শতাংশ ভুক্তভোগী নিজেদের পক্ষে বিচার পান।

সোমবার বিকেলে ঢাকার দৃক গ্যালারিতে ‘‘বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার উপর দৃষ্টিপাত : প্রবণতা এবং সমাধান” বিষয়ক একটি গবেষণায় এমন তথ্য তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশ ও জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম- জেএনএনপিএফ।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মামলাগুলোর প্রতি ৫টির মধ্যে ৪টি মামলাই আদালতে উত্থাপিত হতে ২ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তারপর বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।

একশনএইড বাংলাদেশ এবং জেএনএনপিএফ ‘১৬ দিনব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ উদ্যাপনের প্রেক্ষাপটে ২০টি জেলার ২৮০০টি ঘটনার তথ্য নিয়ে এই গবেষণা করে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন গবেষক আহমেদ ইব্রাহীম।

গবেষণা নিয়ে একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “ঘরে-বাইরে সব জায়গায় আমরা নির্যাতন মেনে নিচ্ছি। আবার যেখানে গিয়ে নির্যাতনের সুরাহা বা বিচার পাওয়া উচিৎ তা পাওয়া যাচ্ছে না। যখনই আমরা কোন না কোন নির্যাতনকে মেনে নিচ্ছি আমরা সহিংসতাকে সমর্থন করছি। ফলে নারীদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। আমরা মেনে নিচ্ছি যে নারী ও শিশুর উপর নির্যতান করা যায়। যখনই আমরা সহ্য করছি তখনই আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি। তাই আমাদের সবার নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে।”

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৭৫ শতাংশ প্রতিবেদনই ধর্ষণ বা গণধর্ষণ সম্পর্কিত। যেখানে প্রতিবেদন বলছে, বেশিরভাগই পারিবারিক সহিংসতার বিষয়। অর্থাৎ, গণমাধ্যম বাড়ির বাইরের সহিংসতা এবং যৌন সহিংসতাকে অধিক হারে তুলে ধরে। এভাবে ‘নারীরা বাড়িতে নিরাপদ’- এই ধারণাকে স্থায়ী করে রাখা হয়েছে। তবে গবেষণা বলছে, নারীরা ঘরেই বেশি অনিরাপদ।

গবেষণার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন “নারীদের ছোটবেলা থেকেই যেকোন সমস্যা লুকিয়ে রাখার শিক্ষা দেয়া হয়। যতদিন পর্যন্ত আমাদের বিচার ব্যবস্থা ন্যূনতম পর্যায়ের নিরপেক্ষ না হবে ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। নারী-পুরুষ উভয়কেই সচেতন করতে হবে। এখানে গণমাধ্যম প্রচার ও প্রকাশনার মাধ্যমে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে”।

নারীদের উপর সহিংসতা ও বিচার না হওয়া বিষয়ে গবেষণায় কারণ হিসেবে বলা হয়, পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ দাখিল সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকে না। একইসঙ্গে এলাকার ক্ষমতাসীনদের বাধা এবং হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাব, ঘরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোন সচেতনামূলক কার্যক্রম না থাকা এবং মামলা ধীরগতির কারণে ভুক্তভোগীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতে চায় না। এছাড়া বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধেই রায় যায় সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার কারনে।

নারীনেত্রী ও নিজেরা করি-এর সমন্বয়ক খুশি কবির বলেন, “আমাদের সমাজে মনে করা হয় নির্যাতন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। আবার নির্যাতনের শিকার একজন নারী থানায় গিয়েও অভিযোগ দিয়ে সহযোগিতা পান না, হয়রানি করা হয় তাকে। আইনী জটিলতায় বিচার পেতে অনেক সময় লাগে। একজন নারী বা একটি পরিবারের পক্ষে টাকা খরচ বা সময় দিয়ে পরিশেষে বিচার পাওয়া খুবই কঠিন। সেকারনে অধিকাংশ মামলার বিচার আলোর মুখ দেখে না।”

গবেষণায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সুপরিশগুলো হলো, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং গৃহে এর ব্যাপকতাকে নির্মূল করার জন্য একটি আইন করা এবং তার বাস্তবায়ন করা; জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নারীরা যেন গৃহে সংঘটিত সকল ধরনের সহিংসতা চিহ্নিত করতে পারে সে বিষয়ে তাদের সচেতনতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নারীরা যাতে সহিংসতার ঘটনার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কিংবা অভিযোগ করতে পারে তার জন্য সকল তথ্য দিয়ে সহযোগিতা নিশ্চিত করবে সরকার; নারীরা যাতে সঠিক উপায়ে আইনগত অভিযোগগুলো দাখিল করতে পারে সে বিষয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া; এবং গণমাধ্যমের উচিৎ পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে নজর দেওয়া।

সহিংসতার নানা ঘটনা সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো ও বিভিন্ন পক্ষকে উদ্যোগী করতে একশনএইড বাংলাদেশ এবং উন্মাদ “ফেমিটুন” নামের একটি ভিন্নধর্মী কার্টুন প্রদর্শনীর আয়োজন করে। গবেষণা প্রতিবেদটি প্রকাশের পর প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করে আয়োজকরা। নারীর প্রতি সহিংসতার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের কার্টুনিস্টরা এই কার্টুনগুলো আঁকেন। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, অবৈতনিক সেবামূলক কাজ, শহরে এবং দুর্যোগে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে সহিংসতার চিত্রগুলো তুলে ধরা হয়েছে। ২৬ নভেম্বর শুরু হয়ে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। প্রতিদিন বিকাল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত যে কেউ ধানমন্ডীর দৃক গ্যালারীতে এই প্রদর্শনী দেখতে পারবেন।