মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ জাতিসংঘের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৬-১৭ ১১:০৭:১২


মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জাতিসংঘ। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের জাতিবিদ্বেষী নীতির কারণে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে সংস্থাটি। মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কেনাট ওস্টবি নেপিদোকে চিঠি দিয়ে  এই বার্তা জানিয়ে দিয়েছেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাস্ত্যুচ্যুতির শিকার হয়ে যে রোহিঙ্গারা এখনও রাখাইনের শরণার্থী শিবিরে (ইন্টারন্যালি ডিসপ্লেসড পার্সনস-আইডিপি ক্যাম্প) থেকে গেছে, তাদের মৌলিক মানবাধিকার ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। মিয়ানমার অবশ্য চিঠিটিকে হুমকি হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের দাবি, ওই চিঠিতে মিয়ানমারকে সহায়তার বার্তা দেওয়া হয়েছে।

২০১২ সাল থেকে প্রায় ১ লাক ২৮ হাজার রোহিঙ্গ রাখাইনে ক্যাম্পে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

২০১২ সালে রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য স্থাপন করা হয় আইডিপি ক্যাম্প। তখন থেকেই এই ক্যাম্পে সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা ও কামান জনগোষ্ঠীর প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার সদস্য এসব ক্যাম্পে বসবাস করে। তবে তাদের চলাফেরায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে মিয়ানমার সরকার। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বিরোধী নতুন অভিযান জোরালো করার পাশাপাশি এসব ক্যাম্প বন্ধ শুরুর অঙ্গীকার করে মিয়ানমার সরকার।

পরে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সম্মত হয় মিয়ানমার। ওই কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, স্বেচ্ছায় ও আলোচনার ভিত্তিতে এসব ক্যাম্পে বসবাসকারী ব্যক্তিদের নিজেদের গ্রাম বা আশেপাশের সম্ভাব্য কোথাও পুনরায় বাসস্থান তৈরি করে দিতে হবে। যেখানে তারা জীবিকার সুযোগ পাবে।

জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন ও মানবিক সংস্থাগুলো বর্ণনা থেকে গার্ডিয়ান জানতে পেরেছে, আইডিপি ক্যাম্পগুলোতে বন্ধের বাস্তবতা চলছে। সেখানে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ ও দুর্দশা অপরিবর্তিত রয়েছে। চলাফেরা, জীবিকা উপার্জনের সুযোগ প্রায় পুরোপুরিই অস্বীকার করা হয়েছে।

গত ৬ জুন তারিখে মিয়ানমার সরকারকে লেখা চিঠিতে দেশটিতে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেছেন, এখন থেকে জাতিসংঘের সহায়তা কেবল তখনই সরবরাহ করা হবে যখন চলাফেরার স্বাধীনতার মৌলিক ইস্যুতে বাস্তব উন্নতি হবে। মিয়ানমার সরকারের বর্তমান নীতি বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকিকেই সুরক্ষিত করছে।

মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আয়ে-কে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, পুরনো ‘বন্ধ থাকা’ এবং নতুন তৈরি করা ক্যাম্পগুলোতে একই অমর্যাদাকর পরিস্থিতি চলছে। সেখানকার বাসিন্দাদের মৌলিক সেবা বা জীবিকার সুযোগ নেই। এমনকি দৃশ্যত অপরিবর্তিত থেকে গেছে ক্যাম্পের অবস্থান।

জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিয়ানমারে সংস্থাটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্প বা তার আশেপাশে স্থায়ী বাড়িঘর নির্মাণে সরকারি পরিকল্পনায় এটা স্পষ্ট যে জাতিবিদ্বেষী বিচ্ছিন্নতা স্থায়ী হবে।

নাগরিকত্ব অস্বীকারের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন থেকেই মিয়ানমারে নিপীড়িত। ২০১২ সালে জনগোষ্ঠীটির হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবর আর ২০১৭ সালের আগস্টের সহিংসতাতেও তা অব্যাগত থাকে। এসব সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা। আর প্রায় বাকি অর্ধেক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে থেকে যায়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মিয়ানমার গবেষক লরা হাই বলেন, রাখাইন বহু বছর ধরেই জাতিবিদ্বেষী রাজ্য। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অসাড় হয়ে রয়েছে। এই অচলাবস্থা চলতে পারে না। আর যতক্ষণ না আমরা রোহিঙ্গাদের অধিকার পুনর্বহালে কার্যকর উন্নতি না হতে দেখছি ততক্ষণ রাখাইনে দাতা সংস্থা, রাষ্ট্র বা অন্যদের সহায়তা সরবরাহ করা হবে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া বিদ্বেষ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ চালিয়ে যেতে দেওয়ার শামিল।

গার্ডিয়ান দেখেছে, আইডিপি ক্যাম্প বন্ধের কাজ আন্তর্জাতিক মানে আনতে জাতিসংঘ বেশ কয়েক মাস ধরেই মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়ে আসছে। ধারণা করা হয় এসব নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ওস্টবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও অস্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার। ফলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পদত্যাগ করতে পারেন ওস্টবি। গার্ডিয়ানের ধারণা ফিলিপাইনে বর্তমানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ওলা আলগ্রিন মিয়ানমারের দায়িত্ব নিতে পারেন।

মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক উপমন্ত্রী সোয়ে অং বলেছেন, ওস্টবির চিঠিকে জাতিসংঘের সহায়তা প্রত্যাহারের হুমকি হিসেবে দেখছেন না তারা। তিনি বলেন, জাতিসংঘের সংস্থা এবং আমাদের মন্ত্রণালয় নিবিড় যোগাযোগ রাখছে আর মানবিক সহায়তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য আমরা খোলামেলাভাবে এবং বারবার আলোচনা করছি।