শ্রমিক থেকে যেভাবে গডফাদার হয়ে ওঠেন নূর হোসেন
আপডেট: ২০১৫-১১-১৪ ২৩:০১:২৮
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিচার দেখার অপেক্ষায় এখন গোটা জাতি। ট্রাকের হেলপার থেকে রাজনীতির পথ ধরে গডফাদার ওঠা এই আসামির ফাঁসীর দাবি এখন সবার মুখে। কিন্তু কিভাবে এই গডফাদারের বেড়ে ওঠা? কাদের হাত ধরে তার উত্থান? বিচার দেখার আগে একটু চোখ বুলিয়ে নিন সেই গল্পের নানা অলিগলি।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ট্রাকের হেলপার দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও দলবদল আর গডফাদারের মাধ্যমে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে এমনটাই উঠে এসেছে। নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠজনের মতে, ১৯৮৯ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। শ্রমিক ইউনিয়নে নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন। সে সময় যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে হয়ে যান বিএনপি নেতা। ১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেনসহ ১৩ জন। সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলামকে পরাজিত করে জয়ীও হন নূর হোসেন। তার পক্ষে ছিলেন সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন। সে সময় ভোট জালিয়াতির অভিযোগও ওঠে।
সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি প্রার্থী হিসেবে পরবর্তী ইউপি নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেন। তখন আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমান প্রার্থী দেন সাত খুনের ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামকে। ওই সময়ে গিয়াসউদ্দিন জোরেশোরে নূর হোসেনের পক্ষে মাঠে নামলেও জয়ী হতে হাত মেলান শামীম ওসমানের সঙ্গে। হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা।
নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয়দের মতে, নূর হোসেন তার নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে পরিবহনে চাঁদাবাজি, শিল্পকারখানায় চাঁদাবাজি, জায়গা-জমি দখল, শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে পাথর বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৯৫ সালে এপ্রিলে নূর হোসেন শিল্পপতি মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে আদমজীতে খালেদা জিয়ার জনসভায় উপস্থিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। এর আগে কর্নেল অলি আহম্মেদের গাড়িতে বোমা মেরে আলোচনায় আসেন তিনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমানের হাত ধরে ফের আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ওই রাতেই এলাকা থেকে সপরিবারে পালিয়ে যান। পলাতক অবস্থায় থেকেও শিমরাইলের মনিরকে দিয়ে এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। কালা শাজাহান, মনির, রাসেল, জুয়েল, ছানা, আলীসহ প্রায় ২০/২৫ জনের ক্যাডারের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল তার। নূর হোসেনের ভাই নূরুজ্জামান জর্জের নেতৃত্বে সোনারগাঁয়ের আমান, ডেমরার সেলিম, বাতেনসহ ১৫/২০ জনের আলাদা বাহিনী গড়ে ছিল তার। এছাড়া তার ভাতিজা শাহজালাল বাদলের নেতৃত্বে জসিম, লিটন, আসলাম, শামীম, সুরুজসহ দুই ডজন সন্ত্রাসী ছিল বলে জানান এলাকাবাসী।
২০১১ সালে নির্বাচনের পর সিদ্ধিরগঞ্জের এরশাদ শিকদার হিসেবে পরিচিত হন চার নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন। সে সময় মাদক ব্যবসা থেকে দিনে তার আয় হতো প্রায় ৩৫ লাখ টাকা! মাদক ব্যবসার কারণে নিজ সন্তান বিপ্লবকে হত্যা করেছিলেন বলে গুঞ্জন রটেছিল। যদিও বিপ্লব গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেছিলেন নূর হোসেন। এলাকাবাসী জানান, নূর হোসেনের শিমরাইল টেকপাড়া বাড়ির মাত্র ৫০০ ফুট দূরত্বের মধ্যেই হাজি আজিম উদ্দিন পেট্রোল পাম্পের গলিতেই প্রকাশেই বিক্রি হতো সব ধরনের মাদক। ব্যবসায়ীসহ এলাকার মানুষদের আটকে রেখে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করা ছিল তার বাহিনীর কাজ।
দুর্ধর্ষ নূর হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করা তো দূরের কথা প্রতিবাদ করার সাহসও পেতেন না কেউ। নূর হোসেন তার বাহিনী দিয়ে মিজমিজি মাদ্রাসা রোডের হাজি সাহাবুদ্দিনের জমি দখল করে ৬০ লাখ টাকা চাঁদা নেয়। সিদ্ধিরগঞ্জের সেভেন সেভেন ইটভাটার মালিক মনির হোসেন বাবুলের ইটভাটা জোরপূর্বক বন্ধ করে দিয়ে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন। নাসিক নির্বাচনে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করায় আমির হোসেন ভান্ডারিকে অবরুদ্ধ করে নির্বাচনের ব্যয় বাবদ ৬০ লাখ টাকা নেন বলেও তা্র বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক ও জনপথের ঠিকাদার মাছুম নূর হোসেনের নির্দেশ ছাড়া সানাড়পাড়-মৌচাক এলাকার ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ নেওয়ায় তার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা নেন। সানাড়পাড়ের ব্যবসায়ী সুলতানের নিকট থেকে দফায় দফায় ৩৮ লাখ টাকা চাঁদা নেন নূর হোসেন।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দুরে শিমরাইল আন্তঃজেলা ট্রাক টার্মিনাল। এই টার্মিনালের পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদকের অভয়ারণ্য গড়ে তোলেন নূর হোসনে। তিনি ও তার সহযোগীদের নিয়ে ওই এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার মাদক বিক্রি হতো তাদের মাধ্যমে। মাদক বিক্রির লাভ থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৫ লাখ টাকা পকেটস্থ করতেন নূর হোসেন। মাদক ব্যবসার টাকা দিয়ে প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করতেন তিনি। এছাড়াও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে নূর হোসেন কাউন্সিলর অফিসকেই মাদকের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
এছাড়াও ২ বছর ধরে নূর হোসেন শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে অশ্লীল নৃত্য, যাত্রা আর জুয়ার আসর বসিয়েছিলেন। প্রতিদিনই মাইকিং করে যাত্রা-জুয়ার আসরে জনগণকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। মেলা থেকে পরিচালনা খরচ ও চাঁদা হিসেবে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু নুর হোসেনই নয়, তার আত্মীয় স্বজনরাও কম যায়নি! তার বড় ভাই হাজী নূর ইসলামকে এলাকার মানুষ ডাকেন ‘খান সাব’ বলে। নূর ইসলাম নিয়ন্ত্রণ করেন বাড়ির সামনে মসজিদের ওয়াকফের জায়গার একটি মাছের আড়ত। আড়তের ৪৭টি ভিটির প্রতিটি থেকে এক লাখ টাকা করে সেলামি নেওয়া হয়েছে। নূর হোসেনের মেজো ভাই নূর সালাম একজন ভূমিদস্যু। এলাকাবাসী তার নাম দিয়েছে ‘বোবা ডাকাত’।
এলাকার জমিজমা কেনাবেচায় তাকে টাকা না দিলেই ঝামেলায় পড়তে হয়। মাদানীনগর, রসুলবাগ, মুক্তিনগর ও বাগমারা এলাকার জায়গা জমিজমার নিয়ন্ত্রণ তার ছিল। তৃতীয় ভাই নূরুল হক মোটা হারে সুদের ব্যবসা ও একটি পরিবহন শ্রমিক সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করেন। চতুর্থ ভাই নূরুদ্দিন স্থানীয় সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদার ও বর্তমানে নূরের অবর্তমানে তার সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করছেন। ছোট ভাই নূরুজ্জামান জজ নিয়ন্ত্রণ করে বালি-পাথর ব্যবসা। একই সঙ্গে টেম্পো, লেগুনা ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা নিয়ন্ত্রণ করেন । তার ভাতিজা কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল (নূর সালামের ছেলে) নেপথ্যে থেকে পিতার অবৈধ কর্মকান্ড ও মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। শিমরাইল মোড়ে যাতায়াতকারী যানবাহনে চাঁদাবাজিও তার নিয়ন্ত্রণে বলে জানা গেছে।
১৯৯৮ সালে নূর হোসেনই বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার চট্টগ্রাম অভিমুখী রোড মার্চের গাড়িবহর আটকে দিয়েছিলেন। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল রেড ওয়ারেন্ট জারি করেছিল। বর্তমান সরকারের আমলে ওই রেড ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও ছিল নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠজন। নূর হোসেনকে দেখা যেতো বিভিন্ন মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে। এমনকি ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে প্রধানমন্ত্রীর এক অনুষ্ঠানের মঞ্চেও নূর হোসেনকে দেখা গেছে। নূর হোসেনকে যারা মদদ দিয়েছেন এমন নেতাদের মধ্যে নাম এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এইচটি ইমাম, আওয়ামী লীগ নেতা মৃণাল কান্তি দাস, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান, অব্যাহতি দেওয়া সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিন মিয়া প্রমুখের।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতার নামও উঠে এসেছে যাদের সঙ্গে নূর হোসেনের ছিল গভীর সম্পর্ক। নূর হোসেনের উত্থানের পেছনে সাবেক জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল ও পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামেরও সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও উঠে এসেছিল। নূর হোসেনকে ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার পেছনেও ছিল ডিসি ও এসপির হাত। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসাও চলতো ডিসি এসপিকে টাকা দিয়ে। জাতীয় সংসদ থেকে সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের ঘটনার আগে পর্যন্ত নূর হোসেনের সঙ্গে অনেক ভালো সম্পর্ক দেখা গেছে শামীম ওসমানের। শামীম ওসমানের সঙ্গে নূর হোসেনের ২৯ এপ্রিল রাতের কথোপকথনের একটি অডিও টেপ প্রকাশের পর তাকেও গ্রেফতারের দাবি উঠে।