বীরোচিত বিদায় বাংলাদেশের
স্পোর্টস ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৭-০৩ ১০:০৪:০৯
ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্বকাপের স্বপ্নযাত্রা শুরু। সেই যাত্রায় কখনও পাখির ডানায়, আবার কখনও ইংল্যান্ডের সাদা মেঘের ভেলায় ভর করে ভেসেছে বাংলাদেশ। টন্টনের সুখস্মৃতি স্বপ্নের সীমানা ছোঁয়ার আশা জাগিয়েছে। সাউদাম্পটন থেকে টাইটানিকে চেপে স্বপ্নের বন্দরে নোঙর ফেলার মিশনে বার্মিংহামে পাড়ি জমায় বাংলাদেশ।
সেখানে স্বপ্নের কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটতে পারত। কিন্তু রোজের বাঁশি বাজল বড় করুণ সুরে। টাইটানিকের ভাগ্যাহত নায়িকার মতো কাল এজবাস্টনের গ্যালারিতে বাঁশি হাতে হাজির হয়েছিলেন বাংলাদেশের এক সমর্থক। ম্যাচ শেষে গ্যালারি তখন ভাঙাহাট। তবু বাঁশি বাজিয়েই চলেছেন লাল-সবুজের সেই সমর্থক।
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন উইকেটে দাঁড়িয়ে হয়তো ভাবছিলেন, বাঁশির সুরে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশকে টেনে তোলার জন্য কেউ তাকে সঙ্গ দিতে আসবেন! চারপাশে এত মানুষ থাকার পরও বাঁশির শব্দ কেউ শুনলেন না। অসহায়ের মতো সেমির স্বপ্নের মৃত্যুঘণ্টা শুনতে শুনতে সাইফউদ্দিন ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন।
নিউজিল্যান্ডের কাছে হার ও শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেস্তে যাওয়ার আফসোসও তখন সাউফউদ্দিনের সঙ্গী। মঙ্গলবার বাঁচা-মরার ম্যাচে তামিম ইকবালের ক্যাচ মিস, তার ব্যাটিং, সৌম্য-লিটনদের উইকেট ছুড়ে আসার ধরন- আক্ষেপ আরও বাড়াল। এজবাস্টনে ভারতের বিপক্ষে ৩১৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২৮ রানের হারে সেমিফাইনালের দৌড় থেকে ছিটকে পড়ল বাংলাদেশ। এক ম্যাচ বাকি থাকতেই শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ।
টাইগারদের হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পর দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনালে চলে গেল ভারত। শুক্রবার পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটা এখন বাংলাদেশের জন্য শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। এজবাস্টনের মাঠ ছোট হওয়ার কারণেই ৩১৫ রানের লক্ষ্যটা পাড়ি দেয়া সম্ভব মনে হচ্ছিল। প্রথম আট ব্যাটসম্যানের সাতজন দুই অঙ্ক ছুঁলেও বড় ইনিংস শুধু সেই সাকিব আল হাসানের (৬৬)।
আটে নেমে সাইফউদ্দিন হাফ সেঞ্চুরি (৫১*) করলেও সাব্বির রহমান (৩৬) ছাড়া কেউ তাকে সঙ্গ দিতে পারেননি। জাতপ্রিত বুমরাহর চার এবং হার্দিক পান্ডিয়ার তিন উইকেটে ১২ বল বাকি থাকতেই বাংলাদেশ অলআউট ২৮৬ রানে। তবে স্বপ্নের সীমানা ছোঁয়া না গেলেও বিশ্বকাপের বিস্ময় বাংলাদেশের বিদায়টা হল বীরের মতোই।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে রোহিত শর্মার সেঞ্চুরি ও লোকেশ রাহুলের ফিফটিতে বিনা উইকেটে ১৮০ রান তুলে ফেলেছিল ভারত। সেখান থেকে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের। জাদুকরী বোলিংয়ে পাঁচ উইকেট নিয়ে ভারতকে ৩১৪ রানে বেঁধে ফেলেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। লক্ষ্যটা নাগালের মধ্যে রেখে ব্যাটিংয়েও চোয়ালবদ্ধ লড়াই করে বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপের উজ্জ্বলতম মুখ সাকিব তুলে নিলেন আরেকটি ফিফটি। ১৭৯ রানে ছয় উইকেট হারানোর পর হাল না ছেড়ে বীরোচিত ব্যাটিংয়ে ভারতকে কাঁপিয়ে দেন সাইফউদ্দিন ও সাব্বির। তবু দিনশেষে গল্পটা হতাশার। একটুর জন্য স্বপ্নের মশাল জ্বালিয়ে রাখতে না পারার আক্ষেপের। এমন বিদায় প্রাপ্য ছিল না বাংলাদেশের।
জয়ের জন্য শেষ ১৫ বলে দরকার ছিল মাত্র ৩০ রান। হাতে ছিল দুই উইকেট। সাইফউদ্দিন যেভাবে ব্যাট করছিলেন, জয়টা খুব সম্ভব বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ৪৮তম ওভারের শেষ দুই বলে রুবেল ও মোস্তাফিজকে বোল্ড করে বাংলাদেশের সেমির স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেন জাসপ্রিত বুমরাহ। ৩৮ বলে ৫১ রানে অপরাজিত থাকেন সাইফউদ্দিন।
এরআগে দিনের শুরুটাই ছিল হতাশামাখা। টস হেরে হাতে তুলে নিতে হয়েছিল বল। সেই দুঃখ ভোলার উপলক্ষ এসেছিল পঞ্চম ওভারে। মোস্তাফিজুরকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রোহিত। কিন্তু সহজ ক্যাচটা হাতে জমাতেই পারলেন না ক্যারিয়ারের ২০০তম ওয়ানডে খেলতে নামা তামিম।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আগের ম্যাচে চার রানে জীবন পেয়ে সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন রোহিত। কাল নয় রানে তামিমের সৌজন্যে নতুন জীবন পেয়ে একই পথে হাঁটলেন ভারত ওপেনার। আসরে নিজের চতুর্থ সেঞ্চুরি তুলে নেয়ার পাশাপাশি লোকেশ রাহুলকে নিয়ে গড়লেন ১৮০ রানের উদ্বোধনী জুটি। ভারত তখন ভয় দেখাচ্ছিল অনেক বড় স্কোরের।
সেখান থেকেই মোস্তাফিজ-ম্যাজিকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। শেষ ১২ ওভারে দুর্দান্ত বোলিংয়ে লক্ষ্যটা নাগালের বাইরে যেতে দেয়নি টাইগাররা। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ওয়ানডেতে পাঁচ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরালেন মোস্তাফিজ। মঙ্গলবার বার্মিংহামের এজবাস্টনে উড়ন্ত শুরুর পরও নয় উইকেটে ৩১৪ রানে থমকে যায় ভারত।
বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার ম্যাচেই মোস্তাফিজ ফিরলেন স্বরূপে। গোটা আসরেই বাংলাদেশের পেস আক্রমণ ছিল নিষ্প্রভ। কাল ৫৯ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে সেই দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দিলেন কাটার মাস্টার।
সাকিব আল হাসানের পর বাংলাদেশের মাত্র দ্বিতীয় বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে পাঁচ উইকেটের স্বাদ পেলেন মোস্তাফিজ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে এটি তার চতুর্থ পাঁচ উইকেট শিকার। যার তিনটিই ভারতের বিপক্ষে। আগের ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নেয়া সাকিবও কাল দারুণ বোলিং করেছেন।
উইকেট মাত্র একটি পেলেও ১০ ওভারে মাত্র ৪১ রান দিয়েছেন এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। মোস্তাফিজ ও সাকিবের দুর্দান্ত বোলিংয়ে শেষ ১০ ওভারে পাঁচ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৬৩ রান তুলতে পারে ভারত। এর মধ্যে শেষ ছয় ওভারে এসেছে মাত্র ৩৭ রান। শেষ ওভারে দুই উইকেট নিয়ে মোস্তাফিজ পূর্ণ করেন পাঁচ উইকেট। ওই ওভারে পড়েছে তিন উইকেট। যার একটি রানআউট।
এর আগে পঞ্চম ওভারে জীবন পাওয়ার পর অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটছিলেন রোহিত। তার সাবলীল ব্যাটিংয়ে ছন্দ পেয়ে যান রাহুলও। ২৯ ওভারেই দু’জন তুলে ফেলেন ১৮০ রান। ৯০ বলে নিজের ২৬তম ওয়ানডে শতক পূর্ণ করেন রোহিত। নিয়মিত বোলাররা ব্যর্থ হওয়ায় সৌম্য সরকারের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন মাশরাফি মুর্তজা।
অধিনায়ককে হতাশ করেননি সৌম্য। ৯২ বলে ১০৪ রান করা রোহিতকে ফিরিয়ে ৩০তম ওভারে দলকে প্রথম ব্রেকথ্রু এনে দেন এই অনিয়মিত পেসার।
সঙ্গীকে হারানোর পর বেশি দূর যেতে পারেননি রাহুল। ৯২ বলে ৭৭ রান করা রাহুলকে এই বিশ্বকাপে নিজের প্রথম শিকারে পরিণত করেন রুবেল হোসেন। দ্রুতই ৪২ রানের জুটি গড়ে সেই ধাক্কা প্রায় সামলে উঠেছিলেন বিরাট কোহলি ও ঋষভ পন্ত। এই জুটিতে শেষের ১০ ওভারে ঝড় তোলার মঞ্চটা তৈরি করছিল ভারত।
কিন্তু ৩৯তম ওভারে জোড়া ছোবলে ভারতকে কাঁপিয়ে দেন মোস্তাফিজ। প্রথমে কোহলিকে (২৬) রুবেলের ক্যাচ বানান। এক বল বিরতিতে মোস্তাফিজের আরেকটি কাটারে বিভ্রান্ত হয়ে শূন্য রানে ফেরেন হার্দিক পান্ডিয়া। ৪১ বলে ৪৮ রান তুলে ফেলা পন্তকে ৪৫তম ওভারে ফেরান সাকিব। এরপর আবার মোস্তাফিজ শো।
৪৮তম ওভারে দিনেশ কার্তিককে তুলে নেয়ার পর ইনিংসের শেষ ওভারে আবার জোড়া আঘাত হানেন মোস্তাফিজ। এবার ফেরান এমএস ধোনি (৩৫) ও মোহাম্মদ সামিকে। মোস্তাফিজের পাঁচ উইকেট শেষ পর্যন্ত দলকে কাক্সিক্ষত জয় এনে দিতে না পারলেও সাত ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়ে আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় পাঁচে উঠে এসেছেন কাটার মাস্টার।
ভারত ৩১৪/৯
বাংলাদেশ ২৮৬/১০
ভারত ২৮ রানে জয়ী