আরো ১১৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে এবছর
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৭-১১ ১১:২৫:২০
দেশের বিভিন্ন এলাকার সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপিত উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকৃত উৎপাদনক্ষমতা প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। এ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় এখনই সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বেশি। চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্ত হচ্ছে আরো ১ হাজার ১৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
চাহিদার তুলনায় সক্ষমতা বেশি হওয়ায় বসে থাকছে উৎপাদন সক্ষমতার উল্লেখযোগ্য অংশ। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাবে, দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। এ হিসাবে প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতার ৩০ শতাংশের মতো বসে থাকছে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরই চালু হবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অন্যতম পায়রা। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট এ বছরই উৎপাদনে আসবে। এর বাইরে বেসরকারি খাতের আরো ছয়টি কেন্দ্র থেকে আসবে ৭২৩ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ। চলতি বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসবে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের উদ্যোগে পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থারমাল পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের বিষয়ে ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট চলতি বছরের মার্চে চালু হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা পিছিয়ে যায়। তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রথম ইউনিটের কমিশনিং হবে বলে জানা গেছে। আর আগামী বছরের জুন নাগাদ চালু হবে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি।
পায়রার পাশাপাশি চলতি বছরই উৎপাদনে আসার অপেক্ষায় রয়েছে বেসরকারি খাতের বারাকা পাওয়ার লিমিটেড, কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস ও ডরিন পাওয়ার জেনারেশনস অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। চট্টগ্রামের শিকলবাহায় কর্ণফুলী পাওয়ারের সঙ্গে ১১০ মেগাওয়াটের এইচএফওভিত্তিক আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে বারাকা পাওয়ার লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেড। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এটি উৎপাদনে আসার কথা। শিকলবাহায় ১০৫ মেগাওয়াটের এইচএফওভিত্তিক আরেকটি আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার ও এর কনসোর্টিয়ামকে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) দেয়া হয় ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে এটি।
বগুড়ায় ১১৩ মেগাওয়াটের দুটি, রংপুরে ১১৩ মেগাওয়াটের একটি ও চট্টগ্রামে ৫৪ দশমিক ৩৬৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটিসহ মোট চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস। বিদ্যুৎকেন্দ্র চারটির মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৩৯৩ দশমিক ৩৬৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১১৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার বগুড়া ইউনিট-২ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্প্রতি শুরু হয়েছে। চলতি মাসে উৎপাদনে আসবে রংপুর ও চট্টগ্রামের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি। আর সেপ্টেম্বরে উৎপাদনে আসবে বগুড়ার ১১৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটি।
বিপিডিবির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৬ জুলাই ডরিন পাওয়ার জেনারেশনস অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের চাঁদপুরের ১১৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর কথা ছিল।
ডরিন পাওয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা মইন বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। আশা করছি এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হবে।
নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলেও বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার উল্লেখযোগ্য অংশ বসে থাকছে। বিপিডিবির দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বুধবারও সক্ষমতার বড় অংশ বসে ছিল। ওইদিন ১৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে উৎপাদনে ছিল না ২৩টি। এর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ ও গ্যাসস্বল্পতার কারণে বন্ধ ছিল ১০টি। বাকিগুলো বন্ধ ছিল চাহিদা না থাকার কারণে।
মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাত চলছে বলে জানান বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। তিনি বলেন, মাস্টার প্ল্যানটিতে থাকা চাহিদার ভিত্তিতেই আমরা আমাদের জেনারেশন ও ক্যাপাসিটি করছি। সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রিজার্ভের জন্য রাখা হয়। প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার সব সময় রোলিং থাকে রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন কারণে। আগামী বছর কেউ যদি আমাদের কাছে বিদ্যুৎ চায়, তাহলে কি আমরা দিতে পারব? এ কারণে সবসময়ই আমাদের অতিরিক্ত সক্ষমতা রাখতে হয়। ২০০৭ সালের আগে এ অবস্থা ছিল না। চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার পর আমরা সরবরাহ নিশ্চিত করেছি। এ কারণে সে সময় আমরা সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে পারিনি, ব্যবসায়ীরাও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। এখন যেহেতু আমরা পরিকল্পনা করতে পেরেছি, এখন তাই প্রজেকশনটাও বেটার। আমার মনে হয় ব্যবসায়ীরাও আস্তে আস্তে এর সুবিধা পাবেন।
বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ উৎপাদন দাঁড়াবে ৩৭ হাজার মেগাওয়াট। সে সময় চাহিদা দাঁড়াবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে আরো ১০ বছর বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব। এজন্য উৎপাদন মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা করে নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করার জন্য সুপারিশ করেছে পাওয়ার সেল।
চট্টগ্রাম জোনে বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সাতটি। দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো অনিয়মিতভাবে উৎপাদনে ছিল। সম্প্রতি এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ার পর গ্যাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলেও সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারছে না বিপিডিবি।
চট্টগ্রামে বিপিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে চারটি গ্যাসনির্ভর, দুটি ফার্নেস অয়েল ও একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। সরকারি গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিদ্যুৎকেন্দ্রের (রাউজান ১ ও ২) সক্ষমতা ৪২০ মেগাওয়াট, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের ২৪২ মেগাওয়াট, শিকলবাহা এসটির ৬০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা সিসিপিপির ২২৫ মেগাওয়াট ও শিকলবাহা পি/পির ১৫০ মেগাওয়াট। এছাড়া ফার্নেস অয়েলভিত্তিক দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র দোহাজারী ও হাটহাজারী প্রতিটির ১০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা মোট ১ হাজার ২৯৭ মেগাওয়াট।
বিপিডিবির বিতরণ বিভাগের তথ্যানুসারে, শিকলবাহা এসটি ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। কেন্দ্রটির লোকবল দিয়ে শিকলবাহা-১৫০ নামের কেন্দ্রটি সচল রাখা হয়েছে। এছাড়া ৪২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার চট্টগ্রাম বিদ্যুৎকেন্দ্রের (১ ও ২) ১ নম্বর ইউনিটটি চালু থাকলেও উৎপাদন হয় ১৬০ মেগাওয়াট। ২ নম্বর ইউনিটটি প্রায় ২০ দিন ধরে বন্ধ। এছাড়া পানি সংকটের কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিপিডিবির চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন বলেন, গ্যাসের সংকট নেই। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিকাংশ কেন্দ্রই পুরনো হওয়ায় নতুন কেন্দ্রগুলো দিয়েই উৎপাদন চালাতে হচ্ছে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক দুটি কেন্দ্র ছাড়াও বেসরকারি কেন্দ্র থেকে পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ায় পুরনো কেন্দ্র চালানোর প্রয়োজন হচ্ছে না।
বর্তমানে শিকলবাহা সিসিপিপি কেন্দ্রে ২২৫ মেগাওয়াট, শিকলবাহা পি/পিতে ১৪০, চট্টগ্রাম বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৬০, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে (৩ ইউনিট) ১২০ এবং হাটহাজারী ও দোহাজারী ফার্নেস অয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। সব কেন্দ্র মিলিয়ে চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।