সমাজ, শিক্ষা ও শিক্ষকতাঃ সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেক্ষাপট
আপডেট: ২০১৫-১১-১৭ ১২:৫৫:২৯
বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে তাদের নির্ধারিত বেতন বা আয়ের পাশাপাশি একটু অতিরিক্ত শ্রমে অতিরিক্ত আয় করার প্রবণতা বেশ ভাল করেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শ কাতর এবং নানা ব্যক্তি এটাকে নানাভাবে গ্রহণ করবেন – এটাই স্বাভাবিক। কেউ বলবেন, এতে করে আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। নিয়মিত অফিসের কাজের পাশাপাশি একটু বেশি পরিশ্রম করে অতিরিক্ত আয় রোজগারে বরং আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অবদান হচ্ছে।
সরকারী, বেসরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অলসভাবে সময় না কাটিয়ে উৎপাদনমুখী ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হচ্ছে। এটাকে সাধুবাদ জানানো উচিৎ। অন্যদল আবার বলতে পারেন যে, এতে করে বরং বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে এবং উপর্যুক্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত অফিসের কাজের পাশাপাশি বাড়তি কাজ করতে গিয়ে নিয়মিত অফিসের কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন – ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক দু’ভাবেই।
তাই দেশের সামগ্রিক অর্তনীতিতে অবদান রাখার কোন প্রশ্নই ওঠে না, বরং এতে করে তাদের নিয়মিত সরকারি কাজে ঢিলেমি ভাব চলে আসে। এমনিতেই জরিপ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তারা ঢিলেমি ও আলসেমিপনার ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভাবে সমগ্র বিশ্বকে পিছনে ফেলে সর্বাগ্রস্থান অধিকার করবে। এবং এরকম আরো অনেক যুক্তি, তর্ক-বিতর্ক আসবে আমাদের এই বর্তমান বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে অর্থনীতির সংখ্যা ও স্টাটিসটিকস আমার কাছে কম বোধগম্য। তাই উপর্যুক্ত বিষয়টি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কী পরিমাণ অবদান রাখছে, বা আদৌ রাখছে কী না, বা এ কারণে বেকারত্বের হার কী পরমিাণ বেড়ে যাচ্ছে – এ বিষয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু নিন্মে দু’একটি কথা অবশ্যই বলার মত।
নিয়মিত অফিসের কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত শ্রমে অর্থোপার্জন করার বিষয়টি আমাদের দেশে অনেক ব্যপ্তি লাভ করেছে। কখন, কীভাবে শুরু হয়েছে তা বড় কথা নয়, কিন্তু এতটুকু বলতে পারি যে সমাজের প্রায় সকল স্তরের মানুষের মধ্যে যে এটি চালু হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূন্র্। গাড়ির চালক-হেলপারদের মধ্য রাস্তা থেকে যাত্রী উঠানো, মুদির দোকানদারদের মুদি পণ্য ছাড়াও মোবাইল রিচাজ্র্রে ব্যাবস্থা রাখা, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নেওয়া (বর্তমানে বেসরকারী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও অন্য বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নিচ্ছেন), বাংলা একাডেমিতে পুস্তক প্রকাশনার ওপর সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু , এবং এরকম অনেক কর্মচারী-কর্মকর্তার গোপনে ও প্রকাশ্যে অন্য অফিস বা প্রতিষ্ঠানে সান্ধ্যকালীন বা অন্য কোন সময়ে জব করার প্রবণতা চরমে পৌঁছে গেছে। অবশ্যই এর পেছনে অনেক কারণ আছে। বাজারে দ্রব্য-মূল্যর উর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যক্তিগত চাহিদার উল্লম্ফন, পর সম্পদশ্রীকাতরতা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বল্প বেতন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই অতিরিক্ত আয়ের যে প্রবণতা তা তাদের নিজ ও নিয়মিত অফিস বা প্রতিষ্ঠানের জন্য সামান্য হলেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। সাথে সাথে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিছু মূল্যবোধও। এই বিষয়টির দিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করবো। অন্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে তা এখানে লিখব না বরং আমি যে পেশায় আছি শিক্ষকতা, এবং সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সেকারণে আমাদের মূল্যবোধ কীভাবে নষ্ট হচ্ছে তা সম্পর্কে লিখছি। সবাই হয়তো একমত পোষণ করবেন না; অথবা হয়তো সকলের ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রযোজ্যও নয়। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রে অবশ্যই সত্য।
আমাদের দেশে সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাদানের মাধ্যম, পদ্ধতি, সুযোগ-সুবিধা, মূল্যায়ন, মান ইত্যাদি এক নয় এটা আমাদের সকলের জানা। সাধারণত সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয় এবং সঙ্গত কারনেই বেশি মেধাবীরা সেখানে চান্স পায় এবং কম মেধাবী ও সচ্ছল পিতামাতার সন্তান ছাত্ররা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেন। এখান থেকেই মেধাবী ছাত্র ও অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে একটা ভাগ ( বিভাজন) তৈরী হয়। তাই এই দুই গ্রুপের ছাত্রের ফলাফলের মধ্যেও একটা প্রাকৃতিক বিভাজন তৈরী হবে।
এটাই স্বাভাবিক। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অপেক্ষাকৃত বেশি মেধাবী বলে তাদের ফলাফলও অপেক্ষাকৃত ভাল হবে, এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ফলাফল অপেক্ষাকৃত কম ভাল হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীতটা ঘটে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেন-তেন ছাত্রের ফলাফল সরকরী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রের ফলাফলের তুলনায় অনেক ভাল হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে?
উপর্যুক্ত প্রশ্নের উত্তরে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের মধ্যে আমি প্রধানতম বলে মনে করি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হয় ভাল পড়ানো হচ্ছে, নতুবাবেশি মার্কস দিয়ে শিক্ষা-বানিজ্যকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা, এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের একটা অলিখিত চাহিদা হচ্ছে তাদের ছাত্রদের ভাল ফলাফল।অবশ্যই সবগুলোতে এটা প্রযোজ্য নয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী শিক্ষকগণ তাঁদের ছাত্রদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনেকটা লিবারেল মনোভাবের পরিচয় দেন এ ভেবে যে, ছাত্ররা অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় করে পড়ছে তাই তাদের একটু…।
এবং একই অজুহাতে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যারা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট-টাইম বা গেস্ট টিচার হিসেবে ক্লাশ নিচ্ছেন, তারাও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনেক লিবারেল।আবার সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রদের ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি। এক্ষেত্রে দাড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি বিষয়েও ছাড় নেই। (যদিও বর্তমানে এগুলো সম্পর্কে অনেকে ততটা সিরিয়াস না এবং এগুলোর প্রচলন কমে যাচ্ছে।)
উপরিল্লিখিত মূল্যবোধ নষ্ট বলতে আমি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছাত্র মূল্যায়নের এই ডাবল স্টার্ন্ডারডকে বুঝিয়েছি। আগেই বলেছি , বিষয়টি সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়, কিন্ত সিংহভাগ শিক্ষক এর বাইরেও নন। আমরা যখন ছাত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’ ও ‘সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’ বিভাজনগুলো মাথায় আনি, তখন অটোমেটিক্যালি আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যটা অনেক ক্ষেত্রে এখান থেকেই ম্লান হতে শুরু করে । আমাদের জন্য ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে আমাদের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিবাদের ভাষা। এবং সাথে সাথে আমাদের অস্তিত্বের সংকটকেও আর চরম করে তোলে। কেননা,
অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসঢ়ষরপরঃ নির্দেমনা থাকে ছাত্রদের বেশি মার্কস দেওয়ার জন্য। এখানে শিক্ষক কোন আপষ না করলে পরবর্তী সিমেস্টারে তাকে আর কোর্স দেওয়া হয় না। আর তাঁর সামান্য সরকারী বেতন তো অনেকাংশে মাসের প্রথম পাঁচ তারিখের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পেটে ক্ষুধা নিয়ে তিনিই বা কত বিদ্যা চর্চা করবেন? ক্ষুধার্ত মানুষের গলার স্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতেই থাকে।
মোরাল, মূল্যবোধ, উপযুক্ত বিচার ইত্যাদি বিষয়কে অর্থের উপরে যত রাখা যায় দেশ, জাতি ও ব্যক্তির জন্য ততই মঙ্গল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ দেশের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী ও বিবেক। তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরো জাতিকে শিক্ষা দেন। তাঁদের হাতেই তৈরী হয় দেশের আমলা, আইনজীবী, পুলিশসহ সমগ্র দেশের প্রশাসনিক, সামাজিক,বিচারিক ও অন্যান্য মেকানিজম। তাই তাঁদের অবস্থান হওয়া উচিত সবচেয়ে শক্তিশালী ও অদম্য। এ জন্য সংশ্লিষ্ট অন্য সকল ব্যক্তিবর্গকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনি শিক্ষকদের নিজেদের অবস্থান ও মর্যাদাকে ধরে রাখতে হলে তাঁদের উচিত হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন হওয়া তা যে মাত্রারই হোক না কেন। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের চোখে তাকে বেশি মার্কস দেওয়া নায্য মনে হলেও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে তা অন্যায়ের শামিল অবশ্যই।
মূল্যবোধগত এই অধপতনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক যে সমস্যা সমূহ সৃষ্টি হচ্ছে তা হলো, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষককে অনেক সময় নিষ্ট, আন্তরিক ও উৎসর্গকৃত হলেও অনেক ক্ষেত্রে নিজ প্রতিষ্ঠানের দু’একটি কাজ ফেলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজটি আগে করে দিতে হয়। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কঠোর সিডিউল মানার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ঝপযবফঁষব এর মধ্যেই করতে হচ্ছে।
শ্রম একটু বেশি দিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল করার প্রয়াস অবশ্যই ব্যক্তি জন্য মঙ্গলজনক। বত্র্মানে বাসা-বাড়িতে এক ধরণের কাজের মহিলার সন্ধান পাওয়া যায় যারা শুক্রবার ব্যতীত অন্য বারগুলো বাসায় কাজ করে, কিন্তু শুক্রবারে মসজিদের সামনে অল্প সময়েবেশি ভিক্ষা পাওয়া যায় বলে সেদিন ভিক্ষা করে। এই বিষয়টি যেমন কোন দেশের অর্থনীতির জন্য সাস্থ্যপ্রদ নয়, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষকগণসহ অন্যন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ছুটির দিনে বা সন্ধ্যার সময়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ নিয়ে নিজের ও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার প্রয়াসও মঙ্গল জনক নয়।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়া তো দূরের কথা, তাদের পরিবারের দৈনিক প্রয়োজন মিটানোর জন্যও পর্যাপ্ত আয় নেই। এজন্য তাঁদের সন্ধ্যাবেলা বা ছুটির দিনে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ মিস করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ বা কোন প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণ করতে হয়।
এভাবে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর যে প্রভূত ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তা পূরণ করা নিশ্চয় কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে।
সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে বেসরকারী এসব খাত সমূহে বেকার লোকদের নিয়োগদানের মাধ্যমে একদিকে যেমন বেকারত্ব কমানো যায়, অন্যদিকে সরকারী কর্মকর্তা -কর্মচারীদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ অর্জনের জন্য ওহপবহঃরাবং প্রদান করা হয়। তাই উপর্যুক্ত বিষয়ে আরো গবেষণা, সেমিনার ও মুক্ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সঠিক পলিসি প্রণয়নের সুপারিশ কম গুরুত্বপূর্ণএজেন্ডা নয়।
মো. হারুন
সহকারী অধ্যাপক
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
(মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর নিজস্ব। www.sunbd24.com-এর সম্পাদকীয় অবস্থানের সঙ্গে এসব অভিমতের মিল আছেই এমন হবার কোনো কারণ নেই। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে www.sunbd2424.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না।)