স্থানীয়  ও জাতীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন একই সঙ্গে

আপডেট: ২০১৫-১১-১৭ ১২:০২:৪০


Musaস্থানীয়তে দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি মিডিয়ায় বলেছে, সরকার তৃনমুল পর্যায়েও গণতন্ত্র পৌঁছে দিতে চায়। স্থানীয় সরকারকে আরও বেশি জবাবদিহি মুলক করার উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে’ (আ.অর্থনীতি, ২৩ অক্টোবর’১৫)।

সরকারের ওই সিদ্ধান্তের পক্ষে বহু বুদ্ধিজীবী বিভিন্নভাবে একই যুক্তি প্রদর্শন করা শুরু করেছেন। তাদের কথার অর্থ হলো-এতদিন পরোক্ষ দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন হয়েছে, এখন সরাসরি হলে সমস্যা কি! তাছাড়া স্থানীয়তে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা না থাকায় জাতীয়তে যে গণতন্ত্র আছে সেখানে তা প্রয়োগ করা জরুরি।

আমরা জানি, স্থানীয় মানুষেরা দীর্ঘকাল যাবৎ স্থানীয়তা, আত্মীয়তা ও আঞ্চলিকতার বন্ধনে আবদ্ধ থেকে, তথা এক ধরনের গণতান্ত্রিক মুল্যবোধ ধারণ করে বসবাস করে আসছে। আর জাতীয়তে গণতন্ত্রের নামে অসুস্থ রাজনীতি বিদ্যমান রয়েছে। সেখানে বিরোধী মতকে সহ্য করা হয় না। সরকার ও বিরোধীদলের নেতা-নেত্রীরা কেউ কাউকে সামান্য সৌজন্য পর্যন্ত দেখান না। তবে স্থানীয়তে শতভাগ গণতন্ত্র আছে সেটাও বলা যাবে না। সেখানেও ক্ষুদ্র স্বার্থবাদ, গোষ্ঠিবাদ, পরিবারতন্ত্র ও সংকীর্ণ আঞ্চলিকতার নামে নানারকম অসুস্থ ঐতিহ্য রয়েছে। সেজন্য জাতীয় ও স্থানীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ একই সঙ্গে শুরু করতে হবে।

জনগণ কোনো না কোনো স্থানীয় ইউনিটে বসবাস করেন। তারা সারাদিন যেসব কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িত রাখেন সেগুলোর প্রায় ৯৫ ভাগই স্থানীয়। সেগুলোর মধ্যে রাস্তাঘাট ব্যবহার করা, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া, বাজারে গিয়ে কেনা-কাটা করা, চায়ের দোকানে কিংবা ক্লাবে আড্ডা দেওয়া, খেলার মাঠ ও পার্ক ব্যবহার করা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রার্থনা করা ইত্যাদি কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

যদিও এসব স্থানীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য স্থানীয় সরকারের হাতে একক ক্ষমতা দেওয়া নেই। তারপরেও এসব স্থানীয় কাজ যারা সুষ্ঠুভাবে করার চেষ্টা করেন কিংবা করার আশ্বাস দেন তাদেরকেই জনগণ বেশি পছন্দ করেন। এক সময় দেখা গেছে, এক শ্রেণীর ত্যাগী ও কাজ পাগল ব্যক্তি নিজের পকেটের টাকা ব্যয় করে অথবা চাঁদা তুলে রাস্তা-ঘাট, স্কুল ও ক্লাব  ঘর নির্মাণ করছেন। এসব কাজের পুরস্কার হিসেবে জনগণ তাকে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বার পদে বসাতেন।

তিনি যদি কোনো দলের হতেন, তাহলে তাকে নিয়ে দলের নেতা-কর্মীরা গর্ব করতেন। আর তিনি যদি স্বতন্ত্র ব্যক্তি হতেন, তাহলে তাকে দলে টানার জন্য নেতারা চেষ্টা করতেন। কিন্তু অসুস্থ দলীয় রাজনীতি স্থানীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ায় সেই ঐতিহ্য আর আগের মতো নেই। তাবে যতটুকু অবশিষ্ট আছে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে সেটুকুও থাকবে না বলে অনেকে আশংকা প্রকাশ করেছেন।

শোনা যাচ্ছে, সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে বহু প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশায় এখন থেকেই মন্ত্রী, এমপি ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে ধারনা দিতে শুরু করেছেন। দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে বলতে গিয়ে অনেকে উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দেন। তারা ভুলে যান যে, সেখানকার নাগরিকেরা স্থানীয় কাজগুলো অপরিহার্য ও দল নিরপেক্ষ হিসেবে দেখে থাকেন

যেমন- ব্রিটেনের শহর, নগর এবং গ্রামগুলো স্থানীয় সরকার বা কাউন্সিল পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কমিউনিটি সেবা, তথা শিক্ষা, পরিকল্পনা, পরিবেশমূলক স্বাস্থ্য, যাত্রীবাহী পরিবহন, অগ্নি নির্বাপক, সামাজিক সেবা, আবর্জনা সংগ্রহ, গ্রন্থাগার, আবাসন ইত্যাদি কাজ এককভাবে করে থাকে। সেখানে স্থানীয় কাউন্সিলে ভোটে দাঁড়ানোর আগে ওসব স্থানীয় কাজ করে স্থানীয়দের আস্থা অর্জন করতে হয়।

এখানে উল্লেখ্য, সিলেটের লুৎফা বেগম ইংল্যান্ডে গিয়ে নার্সিং পেশায় বিশেষ অবদান রাখায় তাঁকে টাওয়ার হেমলেটে ডিপুটি মেয়র পদে (প্রথম বাঙালি মেয়র হিসেবে) নির্বাচিত করা হয়। সেখানকার ভোটাররা স্থানীয় নির্বাচনে শতভাগ উপস্থিত থাকলেও জাতীয় নির্বাচনে সে হারে উপস্থিত থাকেন না। আবার, যারা এতদিন ভারতের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রশংসা করতেন এবং এদেশেও অনুরুপ পদ্ধতি বাস্তবায়নের কথা বলতেন তাঁরাও দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধীতা করা শুরু করেছেন।

তাদের মধ্যে একজন ও দলীয় ভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন নয়’ শীর্ষক এক লেখায় বলেছেন, পশ্চিম বঙ্গের গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের বাধার কারণে ২৫ শতাংশ প্রার্থী তাঁদের মনোনয়ন পত্রই জমা দিতে পারেন নি…’। আরেকজন বলেছেন- ‘দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হলে সমাজ আরও বিভাজিত হয়ে পড়বে। সেজন্য এব্যবস্থা বাস্তবায়নের আগে আরও শলা-পরামর্শ ও মতবিনিময় হওয়া উচিত।

… তবে কেন্দ্রে যেভাবে এমপিরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন স্থানীয়তেও সেভাবে মেম্বারদের কর্তৃক চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার নিয়ম চালু হওয়া উচিত।’ তিনি বলতে চাচ্ছেন, কেন্দ্রে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি আছে বিধায় সেখানে গণতন্ত্র আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। তিনি নিজেও বিভিন্ন টক-শো’তে  বলে থাকেন-‘প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা হ্রাস করতে হবে এবং সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে’।

সকলের জানা রয়েছে,ওয়েষ্ট মিনিস্টার পদ্ধতিতে ক্ষমতার পৃথকীকরণ শতভাগ হয় না। কারণ সেখানে আইন বিভাগের সদস্যরাই প্রশাসন বিভাগে গিয়ে সরকার গঠন করেন। তাছাড়া আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেসির নামে স্থানীয়তে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এতে সেসময় মেম্বাররা কেনা-বেঁচা ও গুম হওয়া সহ বহু অপকর্ম ঘটে। দ্বিতীয় বার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে তিনি কেন যে ‘প্রহসন’ কে স্বাগত জানাচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। তাছাড়া চেয়ারম্যান ও মেয়র নামের পদগুলো একটি ঐতিহ্য লাভ করেছে।

তাদের ক্ষমতা গণতান্ত্রিক করার জন্য বিভিন্ন মেকানিজমের চিন্তা করা যেতে পারে। অর্থাৎ তারা কী চান তা আজ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করতে পারেন নি। সেক্ষেত্রে আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছি, এদেশের গণতন্ত্রের যাত্রা বিলম্বিত হওয়ায় রাষ্ট্রের ২৬টি ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য ডিজাইন গ্রহণ করতে হবে। তার আগে সর্বপ্রথম জাতীয় ও স্থানীয়তে একইসঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ একটি সমতল ভূমির দেশ ও আয়তনে খুবই ক্ষুদ্র। এখানে জাতীয় কাজ ও স্থানীয় কাজ বিদ্যমান। সেজন্য দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা আর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য।

তখন জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এবং যাবতীয় স্থানীয় কাজ স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে। অনেকে মনে করেন, এদেশে স্বশাসনের ঐতিহ্য না থাকায় স্থানীয় সরকারের হাতে একক ক্ষমতা দেওয়া হলে সেখানে দূর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়ে যাবে। সেজন্য স্থানীয় স্তরগুলোকে তত্ত্বাবধান করার জন্য প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। কিন্তু এদেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা বাস্তবানুগ না হওয়ায় জেলাকে প্রদেশের বিকল্প হিসেবে কার্যকর করা যেতে পারে।

বৃটিশরা তাদের শাসনের প্রয়োজনে এদেশে বহুস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার সৃষ্টি করে। এখন উন্নয়নের প্রয়োজনে স্তর হ্রাস সহ সমন্বিত         স্তরবিন্যাস জরুরি। সেক্ষেত্রে জেলাই হতে পারে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর। তখন ‘জেলা সরকার’ এক হাতে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারগুলো ও অন্য হাতে নগরীয় স্থানীয় সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। সেসঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রুপ দিয়ে গণতান্ত্রিক করে দিতে হবে।

তাছাড়া প্রতিটি স্থানীয় সরকারের বাইরে ‘স্থানীয় নির্বাচনিক বোর্ড’ গঠন করে স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত করার ক্ষমতা স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা, জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও এরশাদের ১৮ দফা রচিত হয়েছিল গ্রাম উন্নয়নকে সামনে করে।

এখন পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়নকে সামনে করে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু ২০৫০ সাল নাগাদ এদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠি নগরীয় সুযোগ-সুবিধার মধ্যে এসে যাবে। সেজন্য ‘নগর সরকার’ ব্যবস্থাটি (পাইলটিং আকারে হলেও) এখনই বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষায়ক গবেষক।

 ই-মেইল: musha.pcdc@gmail.com