বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প
সবচেয়ে কম অর্থ যায় দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায়
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০১-১৩ ০৯:২৪:৩৯
উত্তরাঞ্চলের জেলা দিনাজপুর দেশের অন্যতম দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা হিসেবে পরিচিতি।অথচ এই জেলাটিতে বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৫৩ ডলার। অন্যদিকে তুলনামূলক কম দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা নারায়ণগঞ্জে দরিদ্রদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ২ হাজার ৭৯১ ডলার। দারিদ্র্য বিমোচনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশ্বব্যাংকের চলমান প্রকল্পগুলোর অর্থ কাঙ্ক্ষিত সুবিধাভোগীর কাছে কতটুকু পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে, তা মূল্যায়নে জরিপ চালিয়েছে সংস্থাটির একটি দল। স্পেশাল ফেয়ারনেস ইনডেক্স (এসএফআই) নামে পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, দারিদ্র্য বিমোচনের অর্থ সবচেয়ে কম পৌঁছাচ্ছে দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চলে। অন্যদিকে বেশি অর্থ যাচ্ছে তুলনামূলক কম দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চলে।
সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬ অনুযায়ী, দিনাজপুর জেলায় দারিদ্র্যের হার ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর কুড়িগ্রামে এ হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। জেলাটির প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে প্রায় ৭১ জনের আর্থিক অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। অথচ জেলাটিতে দরিদ্রদের জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ মাথাপিছু ৬০ ডলারের কম। একইভাবে মাগুরায় দারিদ্র্যের হার ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও কিশোরগঞ্জে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ হলেও এ দুটি জেলায় বরাদ্দের পরিমাণও প্রায় একই।
বিশ্বব্যাংকের দরিদ্রপ্রতি বরাদ্দে উপরের দিকে থাকা পাঁচ জেলার একটি নারায়ণগঞ্জ। শিল্পসমৃদ্ধ এ জেলায় দারিদ্র্যের হার মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। যদিও জেলাটিতে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প বরাদ্দ মাথাপিছু ২ হাজার ৭৯১ ডলার। এ তালিকায় থাকা মাদারীপুরে দারিদ্র্যের হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ হার মুন্সীগঞ্জে ৩ দশমিক ১, নরসিংদীতে ১০ দশমিক ৫ এবং প্রবাসী অধ্যুষিত ফেনীতে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। এ জেলাগুলোয়ও বিশ্বব্যাংকের দরিদ্রপ্রতি বরাদ্দের হার মাথাপিছু ১ হাজার ২০০ ডলারের বেশি।
বিশ্বব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করছে । অবকাঠামো ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে বাস্তবায়ন হচ্ছে এসব প্রকল্প। বাংলাদেশে চলমান ৪০টি প্রকল্প নিয়ে এসএফআই নামে এ জরিপ চালিয়েছে বিশ্বব্যাংকের দলটি। এর মধ্যে অবকাঠামো ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য ঋণ ও অনুদান দেয়া হয়েছে ৩৭টি প্রকল্পে। আর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে নিয়ে সরাসরি অর্থায়ন করা হচ্ছে বাকি তিনটি প্রকল্পে। এতে জেলাভিত্তিক মাথাপিছু বরাদ্দের পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থায়নের বিবেচনায় প্রকল্পগুলোর আকারেও ভিন্নতা রয়েছে। এর মধ্যে দেড় কোটি ডলার থেকে শুরু করে ৭৪ দশমিক ৫ কোটি ডলারের প্রকল্প রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬২ কোটি ডলার, যা দেশের জিডিপির ২ শতাংশ। গত এক দশকে দারিদ্র্য দূরীকরণে ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে। যদিও দেশের প্রতি চারজন মানুষের একজন এখনো দরিদ্র।
জরিপের জন্য বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সব প্রকল্পের টিম লিডারদের কাছ থেকে জেলা পর্যায়ে বরাদ্দের একটি আনুমানিক হিসাব সংগ্রহ করা হয়েছে। দারিদ্র্যের হার, বিদ্যুত্প্রাপ্তির সুযোগ, মূল পেশা ও শিক্ষার প্রভাবসহ অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রার সর্বশেষ তথ্যের সঙ্গে বরাদ্দের এ তথ্য যুক্ত করা হয়। বিনিয়োগ ও চাহিদার যোগসূত্র খুঁজে দেখতে এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক।
অঞ্চলভিত্তিক ন্যায্যতা যাচাইয়ের সূচকে দেখা গেছে, বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ দেশের ১০ শতাংশ জেলায় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে। আর প্রত্যেক দরিদ্রকে দেয়া বরাদ্দের বিবেচনায় যে তিনটি জেলা শীর্ষে রয়েছে সেগুলোর সবাই ঢাকা বিভাগের। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও মাদারীপুর মাথাপিছু বরাদ্দের বিবেচনায় শীর্ষে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ দেয়া সব অর্থের সমবণ্টন হলে দরিদ্ররা মাথাপিছু ২৬১ ডলার করে পেত। যদিও মাথাপিছু প্রকৃত বণ্টনের পরিমাণ ৫৩ ডলার থেকে ২ হাজার ৭৯১ ডলার। সবচেয়ে বেশি দরিদ্র থাকা ২০ শতাংশ পেয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র ৫ শতাংশ অর্থ। দুর্যোগ, ত্রাণ ও টেকসই পরিবেশ খাতের প্রকল্পগুলোয় নিচের দিকে থাকা ৮০ শতাংশ জেলা বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ অর্থ।
দারিদ্র্যপ্রবণ জেলায় কম অর্থ পৌঁছানোকে বিশ্বব্যাংকের একধরনের ব্যর্থতা বলে মনে করেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্য হলো দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা। তাই বিশ্বব্যাংকেরও উচিত প্রয়োজনের ভিত্তিতে প্রকল্পে অর্থায়ন করা। পরবর্তী সময়েও অর্থায়ন করা প্রকল্পগুলো পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যাশিত সুবিধাভোগীদের কাছে বরাদ্দ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও অসমতা রয়েছে। বাংলাদেশের স্কুলগুলো থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ বরাদ্দ পায় মাত্র ২০ শতাংশ অর্থ। এক্ষেত্রে এসএফআই বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক বলছে, ১০টি জেলায় কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
মূলত এসএফআইয়ের মাধ্যমে জেলাভিত্তিক বরাদ্দের পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। বরাদ্দের বৈষম্যের তথ্য এতে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বরাদ্দের ফলে সুবিধাভোগী ও অসুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যাও নিরূপণ করা হয়েছে এসএফআইয়ের মাধ্যমে। এতে ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দের সময়, আগে যেসব জেলা কম বরাদ্দ পেয়েছিল, সেগুলোকে সহজেই শনাক্ত করা যাবে। কোনো প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়েই যদি এসএফআই টুল ব্যবহার করা হয়, বরাদ্দের সমানুপাতিক বণ্টন সম্ভব। প্রকল্প চলাকালেও এসএফআই টুলটি কাঙ্ক্ষিত সুফলভোগীদের মধ্যে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সানবিডি/এনজে