ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০১-২৩ ১৩:১৫:৫৬


দেশের ৫৫টি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা এক লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। বুধবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক থেকে পরিচালকদের নেয়া ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছেন।

একই সঙ্গে তিনি ঋণখেলাপিদের তালিকাও প্রকাশ করেন জাতীয় সংদদে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্যভাণ্ডারের গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংসদে ওই তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকা অনুযায়ী ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮২২৩টি।

উল্লেখ্য, ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের ঋণের তথ্য এই প্রথমবারের মতো সংসদে প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে শুধু ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হতো। কিন্তু ব্যাংকের পরিচালকদের নামে নেয়া ঋণের কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে এবার সংসদে ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের তথ্য প্রকাশ করা হলেও কোন পরিচালক কোন ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন, সে তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। তবে কয়েকটি ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালকরা কী পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন, সংসদে সে তথ্য দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর এখন পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ১২ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

এর বাইরে একই সময় পর্যন্ত অবলোপন করা খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রয়েছে বেনামি ঋণ। এসব মিলে আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ।

সংসদে উত্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিচালকরা অন্য ব্যাংক ছাড়াও নিজ ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছেন। নিজ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬১৪ কোটি ৭৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা। যা মোট ঋণের শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। নিজ ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন এবি ব্যাংকের পরিচালকরা। তাদের ঋণের স্থিতি ৯০৭ কোটি ৪৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা। এর পরের অবস্থান ব্র্যাক ব্যাংকের। এই ব্যাংক থেকে নিজ পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ৩৬২ কোটি

৫০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। সংসদে অর্থমন্ত্রী জানান, অন্য ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক থেকে। যে কারণে ওই দুটি ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওনা রয়েছে।

অন্য ব্যাংকের পরিচালকরা ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১৯ হাজার ১৭৫ কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা ও এক্সিম ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ১০ হাজার ৫১৩ কোটি ৬৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে পাবে ১০ হাজার ১২৬ কোটি ৭২ লাখ ৫ হাজার টাকা। পূবালী ব্যাংক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে পাবে নয় হাজার ৭৩৫ কোটি ৫২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।

সূত্র জানায়, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে তাদের মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারেন না। অনেক ব্যাংক পরিচালকের শেয়ারের পরিমাণ কম হওয়ায় তারা নিজ ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে পারেন না। যে কারণে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন।

সংসদে অর্থমন্ত্রী আরও জানান, মোট খেলাপি ৮ হাজার ২৩৮টি প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে চার হাজার ১৯৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো অর্থ আদায় হয়নি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মাত্র ২৫ হাজার ৮৩৬ কোটি ৪ লাখ টাকা আদায় হয়েছে।

সংসদে দেয়া তালিকা অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি গ্রাহক এখন অ্যাননটেক্স, এর পরই ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠান দুটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটিই ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, আবার ব্যাংকের ঋণও শোধ করেনি। অ্যাননটেক্সের মালিক ইউনুছ বাদল দেশ ছেড়েছেন, আর ক্রিসেন্টের মালিক এমএ কাদের কারাগারে।

তবে ক্রিসেন্টের আরেক মালিক চলচ্চিত্র প্রযোজক আবদুল আজিজ রয়েছেন বহাল তবিয়তে। অ্যাননটেক্সের কয়েকটি কারখানায় আগুন লেগেছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রিসেন্টের জুতা কারখানা ও শোরুম। সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী খেলাপির শীর্ষ তালিকায় আরও রয়েছে বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও চ্যানেল নাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান। তার কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ব্যবসায়ী মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, নর্থ বেঙ্গল পোলট্রিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ দুই গ্রাহকই নামে-বেনামে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে।

খেলাপির তালিকায় আরও কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামও উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে রহিম আফরোজ, অটোবি, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি, কেয়া, গ্রামীণ শক্তি, সিনহা ইয়ার্ন অ্যান্ড ডায়িং, এনা প্রপার্টিজসহ আরও কয়েকটি।

খেলাপির তালিকায় আরও রয়েছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, রূপালী ব্যাংকের বেনিটেক্স ও গোল্ড আনোয়ার, অগ্রণী ব্যাংকের গ্রাহক জাহাজ ভাঙা ও নির্মাণ খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আবার এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা কয়েকজন গ্রাহকও এখন শীর্ষ খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী এমএনএইচ বুলু। তার খেলাপি ঋণ ২৫০ কোটি টাকা।

বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের বাংলালায়নের খেলাপির পরিমাণ ৫১৮ কোটি টাকা। ব্যবসায়ী সাইদ হোসেন চৌধুরীর পরিবারের এইচআরসি শিপিংয়ের ১৭০ কোটি টাকা। খেলাপির তালিকায় আরও রয়েছে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুন্নু গ্রুপ, ঢাকা ডায়িং, দুসাই হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট।

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে গেছে। এ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিংসহ আরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অ্যাপোলো ইস্পাত, এমারেল্ড ওয়েল্ডও খেলাপি।

আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্সড ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজি ও কক্স ডেভেলপার্সও খেলাপি। বেসরকারি বিমান কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করোলা কর্পোরেশন খেলাপি হয়ে গেছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বর্তমানে খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন ঋণ যুক্ত করলে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় দেড় লাখ কোটি টাকা। গত বছরে ঋণখেলাপিদের বড় সুবিধা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

খেলাপিদের বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এতে সুদহার ধরা হয় সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। আর ঋণ পরিশোধে এক বছরের বিরতিসহ ১০ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধের বিধান করা হয়। এ সুবিধার আওতায় আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রয়েছে।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস