আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই নাশকতা
আপডেট: ২০১৫-১১-২৬ ১৪:১৬:২৮
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, পুলিশের মনোবল ভাঙতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে নিষিদ্ধ জামা’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নতুন করে সংগঠিত হয়ে দেশে নাশকতা ঘটাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়।
রাজধানীর পুরান ঢাকার হোসনি দালানের বোমা হামলায় জড়িত ৫ জেএমবি নেতাকে হাজির করে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা বলেন। একইসঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের বিষয়ের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
বুধবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৫ জঙ্গি হলেন, শাহজালাল (৩৮), হাফেজ মাহমুদ (৩২), চান মিয়া (৩২), মানিক (২৮) ও রাশেদ (২৭)।
বুধবার রাতে রাজধানীর গুলিস্থান থেকে শাহজালাল ও হাফেজ মাহমুদ, মিরপুর ১২ থেকে চান মিয়া, উত্তরা থেকে মানিক এবং কামরাঙ্গীর চর থেকে রাশেদকে আটক করা হয়।
মনিরুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত ৫ জঙ্গি নতুন করে সঙগঠিত জামা’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতৃস্থানীয়। পূর্বে গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যদের তথ্য মতে গতকাল বুধবার রাতে দারুস সালাম এলাকায় অভিযান চালাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন নতুন জেএমবির প্রধান আলবানি ওরফে হোজ্জা ভাই ওরফে মেম্বার ভাই ওরফে শাহাদাত ওরফে মাহফুজ। বহুল আলোচিত হোসনি দালানে বোমা হামলার ঘটনায় অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী ওই মাহফুজ।’
মূলত শায়খ আব্দুর রহমানের ফাঁসি হওয়ার পর জেএমবি নতুন করে এবং দুইভাগে সংগঠিত হতে থাকে। তার একভোগে নেতৃত্ব দেন সাইদুর, তাসনিম, সায়েম, ফারুক নামের কয়েকজন ব্যক্তি। আর অপর অংশে নেতৃত্ব দিতেন আব্দুর রহমানের সরাসরি শিষ্য মাহফুজ, সুমন ও অন্যান্যরা। মাহফুজের নেতৃত্বাধীন জেএমবি এ বছরের শুরু থেকেই সংগঠিত হচ্ছিল- জানান মনিরুল।
তিনি বলেন, ‘হোসনি দালানের হামলায় জড়িত আরো ৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। তবে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এমনকি মাহফুজের মৃত্যুর পর এই জেএমবিতে কে নেতৃত্ব দেবেন সে ব্যাপারেও তথ্য পাওয়া গেছে।’
গ্রেপ্তাকৃত পাঁচ জঙ্গিই প্রশিক্ষত জানিয়ে ডিএমপির এ যুগ্ম কমিশনার জানান, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে চানমিয়া ড্রাইভিং করেন এবং দলের সদস্যদের ড্রাইভিং শেখান। এর আগে পুলিশের কাছ থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন এবং গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেন।
রাশেদ কামরাঙ্গীর চরে থাকেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে বোমা সরবরাহের কাজ করেন। কিছুদিন আগে সেখান থেকে বেশ কিছু বোমা উদ্ধার করা হয়েছিল। সেগুলো রাশেদের বোমা ছিল।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মানিক সদস্য সংগ্রহকারী। দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে সদস্য সংগ্রহ করা তার দায়িত্ব। সংগ্রহ করা সদস্যদের ঢাকায় এনে ‘মগজ ধোলাই’ করে পরে ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে পাঠানো হয়।
মনিরুল জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে এদের ক্যাডার বাহিনী তৈরি হয়েছে। এদের সুইসাইড স্কোয়াডও রয়েছে। হোসনি দালানে ঘটনার পর আশিক নামে গ্রেপ্তারকৃত যুবক এসব তথ্য জানিয়েছেন পুলিশকে। আশিক নিজেও সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য।
গ্রেপ্তারকৃত শাহাজালাল ও হাফেজ মাহমুদ হলেন জেএমবির এই অংশের অর্থদাতা বা অর্থ সংগ্রহকারী। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তারা জঙ্গিকাজের জন্য সংগ্রহ করে। বিশেষ করে এদের নিয়ন্ত্রণাধীন বা মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসায় যেসব সহযোগিতা আসে সেগুলো তারা এখানে ব্যয় করে।
হোসনি দালানে হামলার আগে এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা পরপর তিনটি বাসা পরিবর্তন করে বলে জানান মনিরুল। হামলার আগে কামরাঙ্গীর চরের বাসা থেকেই হামলার পরিকল্পনা করে তারা।
ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার এই প্রধান জানান, বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দল থেকে এসে জঙ্গি মানসিকতাসম্পন্ন কর্মীরা নতুন এই জেএমবিতে সংগঠিত হচ্ছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মহররমে তাদের প্রধান টার্গেট ছিল মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে হামলা করা। পরে তারা জানতে পারেন শিয়াদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হচ্ছে হোসনি দালান। তাই সেখানে হামলার সিদ্ধান্ত হয়। হামলার সিদ্ধান্ত ছিল ২২ অক্টোবর। কিন্তু তার আগেই গ্রেপ্তার হয় জেএমবির অন্যতম নেতা সুমন। সুমন ছিলেন ওই বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। সুমন ধরা পড়ায় বোমা হামলার তারিখ পরিবর্তন হয় এবং নিজে থেকেই দায়িত্ব নেয় মাহফুজ।
জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জানিয়েছেন, পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়া এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষে পুলিশ হত্যা এবং বিভিন্ন ধরনের নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন তারা।
মনিরুল বলেন, ‘নিহত মাহফুজ এর আগে আশুলিয়ার ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এছাড়াও নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত এই গ্রুপটি এই বছরের শুরু থেকেই সংগঠিত হয়ে আসছে। তারা তাদের হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার করছে। যে অস্ত্রগুলো গেরিলা কাজে ব্যবহৃত হয়।’
তিনি জানান, কিছুদিন আগে গাজীপুরের প্রত্যন্ত ও দুর্গম বন থেকে তাদের শেষ মহড়া শেষ করে ফেরার পথে আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যার ঘটনাটি ঘটায়। এদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে আরো তথ্য বের করা হবে।
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সংগঠনটি বিচ্ছিন্নভাবে নিজেরাই উৎসাহিত হয়ে সহিংসতা ঘটাচ্ছে এবং বিভিন্ন নাশকতার দায় স্বীকার করছে। এসব করে তারা মূলত আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। এদের অর্থ আসে মূলত তাদের সদস্যদের কাছ থেকে।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ অক্টোবর শুক্রবার রাতে পুরান ঢাকার হোসনি দালান ইমামবাড়ায় মহররমের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে ভয়াবহ বোমা হামলা হয়। এতে ঘটনাস্থলে এক কিশোর নিহত হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো একজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১০০ জনেরও বেশি।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ওই তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতে পুরান ঢাকার ইমামবাড়ায় সমবেত হন নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ। তাদের অধিকাংশই শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও ইসলাম ধর্মাবলম্বী অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও সেখানে অংশ নিয়েছিলেন।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) শহীদ হওয়ার দিনকে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা ত্যাগ ও শোকের প্রতীক হিসেবে পালন করে থাকে।