বড় বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে বৈশ্বিক অর্থনীতি?
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৩-০১ ১১:১৪:৩২
বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় এক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে নভেল করোনাভাইরাস। কভিড-১৯ আতঙ্কের নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক শেয়ারবাজার, পণ্যবাজার ও শিল্প-বাণিজ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ভালোভাবেই।
চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (এনবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারিতে চীনের কারখানাগুলোয় উৎপাদন কার্যক্রম নেমে এসেছে রেকর্ড সর্বনিম্নে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে গতকাল প্রকাশিত পরিসংখ্যানে। ফেব্রুয়ারিতে চীনা কারখানাগুলোয় উৎপাদন কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান সূচক পারচেজিং ম্যানেজার ইনডেক্স (পিএমআই) নেমে এসেছে ৩৫ দশমিক ৭ পয়েন্টে। প্রসঙ্গত, পিএমআই সূচকের মান ৫০-এর বেশি হলে সেটি দ্বারা উৎপাদনে ঊর্ধ্বমুখিতা বোঝায়। কম হলে তাতে প্রকাশ পায় উৎপাদনের নিম্নমুখিতা।
২০০৫ সাল থেকে নিয়মিতভাবে পিএমআই সূচক প্রকাশ করছে চীন। দেশটির গত মাসের পিএমআই সূচকমান ওই সময়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন।
এনবিএস বলছে, এ সময় চীনে ভোক্তা শিল্পপণ্যের বাজারে চাহিদায় ব্যাপক পতন ঘটেছে। এছাড়া যেসব ক্ষেত্রে জনসমাগমের মতো বিষয় সংশ্লিষ্ট যেমন—পরিবহন, আবাসন, ক্যাটারিং, পর্যটন ইত্যাদি খাতেও বেশ মন্দা ভাব দেখা দিয়েছে।
সূচকে যতটা উঠে এসেছে, পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও অনেক খারাপ বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। টোকিওভিত্তিক আর্থিক সেবাপ্রতিষ্ঠান নোমুরা হোল্ডিংস লিমিটেডের চিফ চায়না ইকোনমিস্ট লু তিংয়ের সন্দেহ, আদতে অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। কারণ উৎপাদন পিএমআই সূচকে তথ্য বিকৃত করা হয়েছে। এক গবেষণা নোটে এ সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এ বছর ব্যাপক মাত্রায় নিচে নেমে আসবে বলে এক নোটে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এএনজেড রিসার্চের চিফ চায়না ইকোনমিস্ট রেমন্ড ইউয়াং। এক নোটে তিনি বলেন, এ বছর চীনের প্রবৃদ্ধি নেমে আসতে পারে ৪ দশমিক ১ শতাংশে। যেখানে গত বছরও এর হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
বৈশ্বিক মোট জিডিপিতে চীনের অংশ ১৬ শতাংশ। দেশটির উৎপাদন কার্যক্রমের এ নিম্নমুখিতায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সার্বিক মন্দা ভাবের শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফেব্রুয়ারিতে দেশটির অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে এখন পর্যন্ত এটিই প্রথম প্রকাশিত সরকারি উপাত্ত। এ ভয়াবহ মাত্রার প্রভাব শিগগিরই বিশ্বের অন্যান্য অর্থনীতিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ তাদের উৎপাদন কার্যক্রমের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহে চীনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়েছে। কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদন কার্যক্রমেও বেশ ভাটা পড়ছে। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এদিক থেকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির দেখা এখনো মেলেনি।
এতে বলা হয়, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে করোনাভাইরাসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হবে মার্চের মাঝামাঝি। ফলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার কোম্পানি অস্থায়ীভাবে পণ্যের উৎপাদন এবং মূল্য সংযোজন কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। এদিক থেকে যেসব কারখানা চীনা বন্দর ও পণ্যের ওপর নির্ভরশীল, সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থানে থাকবে সেসব কারখানাই।
বৈশ্বিক শেয়ারবাজারেও নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা এখন চরমে। শুক্রবার টানা সপ্তম দিনের মতো পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের সাপ্তাহিক লেনদেন। বাজারে লেনদেনকারীদের শঙ্কা, কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বব্যাপী মুনাফার ধারা থেকে বিচ্যুত হতে পারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো, যার ধারাবাহিকতায় মন্দার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলো। তাদের এ শঙ্কাই কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজারকে নিম্নমুখী করে রেখেছে।
সাংহাই কম্পোজিট সূচকে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ পতনের মধ্য দিয়ে শুক্রবার শেষ হয়েছে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সাপ্তাহিক লেনদেন। একই হারে পতন হয়েছে জাপানের নিক্কেই সূচকের। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার বেঞ্চমার্ক সূচক কমেছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
তথৈবচ দশা ইউরোপীয় শেয়ারবাজারেরও। শুক্রবার জার্মানির ডিএএক্স সূচক ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, লন্ডনের এফটিএসই ১০০ সূচক ৩ দশমিক ৪ ও ইতালির এফটিএসই এমআইবি সূচক ৩ দশমিক ৬ শতাংশ পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শেয়ারবাজারের সাপ্তাহিক লেনদেন।
একই পরিস্থিতি মার্কিন শেয়ারবাজারেরও। গত সপ্তাহে ডাও জোনস সূচক কমেছে ৯৫০ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ৩ দশমিক ৩ ও নাসডাক কম্পোজিটের ২ দশমিক ৬ শতাংশ পতন হয়েছে গত সপ্তাহে।
সার্বিক দিক বিবেচনায় বলা যায়, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর এখন পর্যন্ত গত সপ্তাহেই সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার। গত সপ্তাহে বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যের সূচক প্রকাশকারী এমএসসিআই ইনডেক্সের পতন হয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এ সূচকও গত সপ্তাহে ২০০৮ সালের অক্টোবরের পর সবচেয়ে বড় পতনের মধ্য দিয়ে গেল।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিলে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে ১ লাখ কোটি ডলার হারিয়ে যাবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউরো জোনসহ অন্যান্য বড় অর্থনীতি পড়বে মারাত্মক মহামন্দার মুখে।
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদনে নিম্নমুখিতার স্পষ্ট প্রভাব দেখা যাচ্ছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারে। নিউইয়র্কে শুক্রবার জ্বালানি তেলের মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) বিক্রি হয়েছে প্রতি ব্যারেল ৪৪ ডলার ৭৬ সেন্ট মূল্যে। গত সপ্তাহে ডব্লিউটিআইয়ের দাম কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। ডাও জোনসের তথ্য বলছে, সাপ্তাহিক পতনের হার হিসেবে এটি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। অন্যদিকে গত মাসে এর সার্বিক মূল্যহ্রাসের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশের বেশি।
অন্যদিকে লন্ডনে বৈশ্বিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের মূল্য স্থির হয়েছে প্রতি ব্যারেল ৫০ ডলার ৫২ সেন্টে। এর মধ্য দিয়ে পণ্যটির গত সপ্তাহে মোট পতনের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশে। ব্রেন্টের সাপ্তাহিক মূল্যহ্রাসের দিক থেকে এটি ২০১৬ সালের জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। অন্যদিকে গত মাসে ব্রেন্টের মোট দাম কমেছে ১৩ শতাংশ।
এ সম্পর্কে শিকাগোভিত্তিক পণ্যবাজার বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান প্রাইস ফিউচার্স গ্রুপের সিনিয়র মার্কেট অ্যানালিস্ট ফিল ফ্লিনের বরাত দিয়ে মার্কেটওয়াচ জানিয়েছে, জ্বালানি তেলের বাজারে চাহিদা যেন কমে একেবারে থমকে দাঁড়িয়েছে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত আপত্কালীন বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা ও দাম দুটোই বাড়তির দিকে থাকে। কিন্তু এ মুহূর্তে মূল্যবান ধাতুটির বাজারও স্বাভাবিক আচরণ করছে না। শেয়ারবাজারের মতো স্বর্ণের বাজার এখন পড়তির দিকে।
নিউইয়র্কের বাজারে বর্তমানে প্রতি আউন্স স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৬ ডলার ৭০ সেন্টে। শুক্রবার সাপ্তাহিক লেনদেনের শেষ দিনেই পণ্যটির দাম কমেছে আউন্সে ৭৫ ডলার ৮০ সেন্ট বা ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে গত সপ্তাহে মূল্যবান ধাতুটির দাম কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ।
ধাতুটির বাজারের এ অস্বাভাবিক চিত্রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গোল্ড নিউজলেটারের সম্পাদক ব্রিয়েন লানডিন মার্কিন একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিনিয়োগকারীরা এখন যেভাবে পারছেন সব বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্বর্ণের মতো সাধারণ হেজ বিনিয়োগও এখন এ বিক্রয়প্রবণতার আওতায় পড়ে গেছে। ২০০৮ সালের মন্দার আগেও বাজারের এ ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়েছে আমাদের। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা যখন অনুধাবন করতে পারেন, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিগগিরই প্রণোদনা নিয়ে এগিয়ে আসবে, সে সময় তাদের মধ্যে স্বর্ণ ক্রয়প্রবণতা ফিরে আসে। (এএফপি, সিএনএন, মার্কেটওয়াচ ও হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ অবলম্বনে)
সানবিডি/ঢাকা/এসএস