বারোমাসি পেঁয়াজ চাষ পাহাড়ে

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৩-০৩ ১১:১৩:২১


টাকায় ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ ছোঁয়া পেঁয়াজের দুর্দিন চলছে। আমদানি করেও দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত বারোমাসি অধিক উৎপাদনশীল বারি পেঁয়াজ-৫ চাষ করে পেঁয়াজের সংকট আগামী এক বছরেই দূর করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা।

খাগড়াছড়িতে পরীক্ষামূলকভাবে পেঁয়াজ চাষে সাফল্য দেখে এমন মন্তব্য করেছেন তাঁরা। এমন সফলতায় খুশি শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বারি পেঁয়াজ-৫ খাগড়াছড়ির পাহাড়-সমতলের সবখানে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা শিগগিরই বারি পেঁয়াজ-৫ চাষাবাদ প্রযুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের মসলা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন।

জানা গেছে, এবার লেট সামারে (নাভি গ্রীষ্মকালীন) খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কয়েকটি প্রদর্শনী প্লটে বারি পেঁয়াজ-৫ এর চাষাবাদ করা হয়। এতে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন কৃষি গবেষকরা। খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে কেন্দ্রের ভেতর নতুন প্রযুক্তির পেঁয়াজ পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হয়। দেশের পেঁয়াজের বর্তমান সংকটময় সময়ে বারি পেঁয়াজ-৫ এর প্রদর্শনী প্লট দেখতে এসে রীতিমতো অভিভূত হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, কৃষি গবেষণার মহাপরিচালক ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।

এ ছাড়া কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুল ওহাব গবেষণা কেন্দ্রের প্রদর্শনী মাঠ থেকে পেঁয়াজ তুলেছেন। প্রদর্শনী মাঠ থেকে তোলা এক একটি পেঁয়াজের ওজন মেপে দেখা গেছে ১৮০-২০০ গ্রাম পর্যন্ত। মাত্র ৫টি পেঁয়াজেই এক কেজি পূর্ণ।

২০০২ সালে উন্নত জাতের পেঁয়াজ উদ্ভাবন করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন তৎকালীন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) সরেজমিন বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাব্বত উল্ল্যা। যা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণার বীজবোর্ড কর্তৃক মুক্তায়িত করা হয়। কিন্তু নীতি নির্ধারকদের ‘দূরদর্শিতার অভাবে’ পেঁয়াজের নতুনজাতটি মাঠ পর্যায়ে ছড়ায়নি তখন। বারি পেঁয়াজ-৫ জাত গ্রীষ্মকালীন হিসেবে উদ্ভাবন হলেও শীত, গ্রীষ্মে যে কোনো ধরনের মাটিতেই উৎপাদন হয়ে থাকে। পাহাড় চূড়াতেও এই পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়। ২০১১ সালে খাগড়াছড়িতে পাহাড় চূড়ায় এই পেঁয়াজের সফল পরীক্ষা চালানো হয়।

এই পেঁয়াজের উদ্ভাবক বর্তমানে অবসরে থাকা ড. মহাব্বত উল্ল্যা বলেন, ‘২০০৮ সালে পেঁয়াজটির জাত মুক্তায়িত করার পর তৎকালীন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পদক্ষেপ নিলেও অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘ ১২ বছরেও তা মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে পেঁয়াজের সংকট মোকাবিলায় পেঁয়াজ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ এবং মাঠে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার।’

‘যেহেতু এই জাতটি যে কোনো ল্যান্ড টাইপে (যে কোনো ধরনের ভূমি) করা যায় এবং জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের ২০ তারিখ পর্যন্ত চাষাবাদ করা সম্ভব; সেহেতু দেশে বর্তমানে ৮-১০ লক্ষ টন ঘাটতি মোকাবিলায় এ জাতটি বিশেষভাবে উপযোগী।’-যোগ করেন ড. মহাব্বত।

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী রাশীদ আহমদ জানান, যেখানে প্রতি হেক্টরে স্থানীয় জাতের পেঁয়াজ হয় ৭/৮ টন, সেখানে নতুন জাতের এই পেঁয়াজ গড় ফলন ২৫ টন। এক একটি পেঁয়াজের ওজন হয় ১৮০-২০০ গ্রাম পর্যন্ত।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুল ওহাব বলেন, ‘দেশে ৩০-৩২ লক্ষ টন চাহিদার বিপরীতে স্থানীয়ভাবে যে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে তাতে ঘাটতি থাকে প্রায় ৭-৮ লক্ষ টন। বিশেষ ধরনের পেঁয়াজটি যেহেতু বছরে ৩ বার ফলানো যায়, সুতরাং অধিক উৎপাদনশীল বারি পেঁয়াজ-৫ এর চাষ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আগামী এক বছরের মধ্যেই পেঁয়াজের সংকট কাটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হতে পারে।’

তিনি জানান, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ হিসেবে জাতটি ১২ বছর আগে রিলিজ (অবমুক্ত) হলেও তখন পেঁয়াজ চাষে কৃষকরা লাভবান না হওয়ায় এতদিন এদিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এখন সংকটাপন্ন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সরকার এদিকে দৃষ্টি দিয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানীরাও এই পেঁয়াজটি কৃষকের মাঠে নিয়ে গিয়ে উৎপাদন বাড়ানোতে নজর দেবেন।

নতুন জাতের বারো মাসি পেঁয়াজ সমতলের চেয়ে পাহাড়ে এর উৎপাদন কোনো অংশেই কম নয়; বরং এখানে শীতে পেঁয়াজের উৎপাদন সমতলের চেয়ে বেশি হয়। কারণ এখানে শীতের দীর্ঘতা বেশি হওয়ায় পেঁয়াজের জন্য পোয়াবারো। এ ছাড়া আরেকটি ব্যতিক্রমী ব্যাপার হলো-পাহাড় টিলাতেও পেঁয়াজের ভালো ফলন হয়। একই জমিতে তিনবার পেঁয়াজ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। এই জাতের পেঁয়াজে চারা থেকে বীজ এবং কন্দ থেকেও বীজ করা যায়। এ মৌসুম বারি পেঁয়াজ-৫ এর বীজ উৎপাদনের নির্ধারিত সময়।

কেবল পাহাড়ি অঞ্চলের পতিত জমি সারা বছর ব্যবহার করেই পেঁয়াজের চলমান ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব বলে কৃষিবিজ্ঞানীরা আশা করছেন।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস