করোনা সংকট
ইতালিতে অবৈধ ৫০ হাজার প্রবাসীর আয়-উপার্জন বন্ধ
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৩-১৮ ০৯:১২:৪০
চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া ভয়ঙ্কর নভেল করোনাভাইরাসের আগ্রাসন মোকাবেলায় লকডাউনে গোটা ইতালি। অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছেন দেশটির নাগরিকসহ সেখানে অবস্থানরত বিদেশীরাও। এ লকডাউনে বন্ধ হয়ে পড়েছে সেখানকার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা কাজে যেতে না পারলেও বেতন-ভাতা তুলছেন ঠিকই। আর্থিক সংকট মোকাবেলায় মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে ভর্তুকি দেয়ারও নিশ্চয়তা দিয়েছে দেশটির সরকার। তবে এসব সুবিধা শুধু সেখানকার নাগরিক ও বৈধ অভিবাসীদের জন্য। ফলে বিপাকে পড়েছেন দেশটিতে অবস্থানরত অবৈধ অভিবাসীরা, যাদের মধ্যে বাংলাদেশী রয়েছেন ৫০ হাজার। এসব সুবিধার কোনোটিই কপালে জুটছে না তাদের।
ইতালিতে বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসীরা মূলত ভাসমান ব্যবসা ও চুক্তিবিহীন কাজ করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটিতে অবস্থানরত অভিবাসীরা সরকারের দেয়া সব সুযোগ-সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন।
জানা গেছে,দেশটির রাজধানী রোম, মিলান, ভেনিস, পাদুয়াসহ অন্তত ১০টি বড় শহরে বাংলাদেশীরা বসবাস করেন। এদের বড় একটি অংশ রয়েছেন রোম ও মিলান শহরে। এর মধ্যে মিলানে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন সেখানেই। মিলানের ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট, বার, পিত্জা ক্লাব, স্টেশনারি, ফ্যাক্টরি, সুপারশপে বহু অবৈধ বাংলাদেশী কাজ করেন। এদের মধ্যে কেউ চুক্তিভিত্তিক, আবার কেউ মাসিক বেতনে কাজ করেন, যাদের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। লকডাউনের কারণে তাদের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে পড়েছে পুরোপুরি।
ইতালি প্রবাসীরা জানান, দেশটিতে সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক চুক্তিভিত্তিক যেসব বাংলাদেশী কাজ করতেন, তাদের অবস্থা খুব খারাপ। কারণ তাদের কাছে গচ্ছিত কোনো অর্থ নেই। নেই কাজে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা। ফলে কাজ করে যে অর্থ পেতেন, তা দিয়েই কোনোভাবে জীবন যাপন করতেন তারা। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ইতালি সরকার ৫০০ ইউরো দেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে, সে সুবিধাও পাবেন না তারা।
তারা বলছেন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বার, পিত্জা ক্লাব বন্ধ থাকায় সেখানে অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশীদের বর্তমানে কাজ নেই। এদের যারা চুক্তিভিত্তিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা এখন অর্থ সংকট আর অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করছেন। অবৈধ এসব বাংলাদেশী ইতালি সরকারের অর্থ সহায়তা থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি বাংলাদেশেও ফেরার সুযোগ নেই তাদের। এছাড়া দূতাবাস থেকেও তাদের সহায়তার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এমনই এক ব্যক্তি মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান। ইতালির মিলান শহরের একটি ক্লাবে কাজ করেন তিনি। করোনার কারণে বর্তমানে পিত্জা ক্লাব বন্ধ। তাই এখন কাজ নেই তার। চুক্তিভিত্তিক হওয়ার কারণে কাজে পুনরায় ফেরারও নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তিনি। ফলে আগামীতে কীভাবে চলবেন, সে বিষয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
একই অবস্থা সৌরভ আহমেদেরও। একটি বার ক্লাবে কাজ করতেন তিনি। চুক্তিভিত্তিক কাজ করলেও বেশ ভালো টাকা পেতেন। হঠাৎ করে ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অবসর জীবন যাপন করছেন তিনি। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আর কীভাবে সেখানে থাকবেন তা নিয়ে তিনি বেশ আতঙ্কিত।
শুধু অর্থ সহায়তা নয়, চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তাও নেই সেখানে। নিরব আহম্মেদ শোয়েব নামে এক বাংলাদেশী জানান, তিনি পরিবার নিয়ে সেখানে থাকেন। বেশ কিছুদিন আগে তার একটি সন্তান হয়। সন্তান অসুস্থ হওয়ায় হাসপাতালে চিকিৎসকদের বারবার ফোন দিয়েও পাননি তিনি। করোনা আতঙ্কে জ্বর, নিউমোনিয়ার কথা শুনলেই তারা ফোন রেখে দেন।
অসহায় অবস্থার কথা জানিয়েছেন মিলানের বাংলাদেশী ফুল ব্যবসায়ীরাও। ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন জানান, মিলানে অন্তত দেড়শ বাংলাদেশী রয়েছেন, যারা দোকান ভাড়া নিয়ে ফুলের ব্যবসা করেন। বর্তমানে এ ব্যবসায় পুরোপুরি ভাটা পড়েছে। লোকসমাগম, পর্যটক না থাকায় আগে থেকেই ফুলের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছিল। তার ওপর করোনার কারণে ফুলের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে ব্যবসা না থাকায় দেশে ফিরে গেছেন। আবার অনেকে দোকানপাট বন্ধ করে ঘরে বসে আছেন। কিন্তু এ অবস্থা চলতে থাকলে শেষে কী হবে তা ভেবে দিশেহারা তিনি।
জানা গেছে, বর্তমানে ইতালিতে প্রায় দুই লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৫০ হাজার রয়েছেন অবৈধভাবে। অবৈধভাবে যারা আছেন, তারা প্রায় প্রত্যেকেই পর্যটনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসার (ভ্রাম্যমাণ) সঙ্গে জড়িত। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় বৈধভাবে থাকা অনেক বাংলাদেশীও সেখানকার পর্যটন অঞ্চলগুলোয় হকারের কাজ করেন। বর্তমানে ইতালিতে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সেখানে বৈধ-অবৈধভাবে অবস্থানরত কমপক্ষে দেড় লাখ বাংলাদেশী। কিন্তু গোটা ইতালি লকডাউন হয়ে পড়ায় হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এসব ব্যবসায়ী।
করোনার কারণে ইতালি সরকার বিভিন্ন সুপারমার্কেট, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, ফ্যাক্টরি, ম্যাগাজিন দোকান, বিভিন্ন পরিবহনের টিকিট অফিস ২৫ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা দিয়েছে। এর বাইরে স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, মিউজিয়াম, থিয়েটারও বন্ধ থাকবে আগামী ৩ এপ্রিল পর্যন্ত। একই সঙ্গে করোনার প্রাদুর্ভাব রুখতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে ইতালিতে।
প্রয়োজন ছাড়া জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে কেউ বাইরে বের হলে ২০৬ ইউরো জরিমানার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। জরুরি আইন অমান্য করায় এরই মধ্যে ছয় হাজার নাগরিককে মোটা অংকের জরিমানা করেছে ইতালির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইভাবে এ জরুরি অবস্থা অমান্য করায় সোমবার সাত বাংলাদেশীকে আটক করা হয়।
প্রসঙ্গত, চীনের পর নভেল করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ইতালিতে। এ পর্যন্ত দেশটিতে মারা গেছে ২ হাজার ১৫৮ জন। আক্রান্ত হয়েছে ২৭ হাজার ৯৮০ জন। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে মিলান শহরে।
এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের নিয়ে স্পষ্ট করে সেখানকার বাংলাদেশী দূতাবাসের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান সিকদার। একই সঙ্গে অতিপ্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া এবং প্রয়োজন হলে দূতাবাসের হটলাইন নম্বরে (+৩৯ ৩৩৩৭৪৪১৬৯০, +৩৯ ৩৮৯৪৭৫৬৯০২) ফোন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।