মহাসঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৩-১৮ ১০:৩৪:০৮


ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় সঙ্কটের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। চীন থেকে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল দেরিতে আসায় এরই মধ্যে কোন কোন কারখানায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরও কিছু কারখানা যথাসময়ে উৎপাদনে না যাওয়ার শঙ্কাতেও রয়েছে। তবে চীনের পর ইউরোপে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এবার শঙ্কা দেখা দিয়েছে পোশাক সরবরাহ নিয়ে।

চীনে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কিছুটা উত্তরণ ঘটলেও ইউরোপে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়াকে ‘মহাসঙ্কট’ হিসেবে দেখছেন দেশের পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ক্রেতারা এখন বিদ্যমান ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। নতুন করে পাওয়া যাচ্ছে না অর্ডারও। আর নির্দিষ্ট সময়ে পোশাক রফতানি (শিপমেন্ট) না হলে ‘অর্থ সঙ্কটে’ পড়বেন পোশাক মালিকরা। এতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ ও ঈদ বোনাস দিতে বেগ পোহানোর আশঙ্কাও করছেন তারা।

করোনা পরিস্থিতিকে ‘উভয় সঙ্কট’ আখ্যা দিয়ে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘আমরা প্রায় দেড় মাস ধরে কষ্ট করেছি। নিট কাপড়ে যেহেতু স্বয়ংসম্পূর্ণ, শতকরা ৮৫ ভাগ আমরা নিজেরাই করি, সেজন্য হয়তো তেমন সমস্যা হয়নি। একটু হায়ার ভ্যালু, বিশেষত নন-কটনের ক্ষেত্রে ঝামেলা হয়েছে। এই খাতের কাঁচামাল আমদানিতে আমরা ৪৯ ভাগ চীনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় আমরা বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছি। সেটা কিছুটা সামলে উঠতেও চেষ্টা করছি, কিন্তু এখন আবার ডিমান্ড সাইডে (ইউরোপ) সমস্যা শুরু হয়েছে। ফলে আমরা এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছি।’

প্রায় কমবেশি সব ক্রেতাই এখন পণ্য উৎপাদন স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে জানিয়ে রুবানা বলেন, গত পরশু পর্যন্ত ২০টি কারখানা যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে লিড বায়ার অন্তত সাত জন এবং প্রত্যেকেই বলছেন, (উৎপাদন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া) দয়া করে স্থগিত (হোল্ড) রাখুন। আমরা পরবর্তী সময়ে আপনাদের জানাব। তবে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যখনই কোন ক্রেতা বিক্রি-বাট্টায় একটু ঝামেলায় পড়েন, তখন বলেন যে তাদের সেলস ভাল না, তোমরা ‘হোল্ড করো’, আমরা পরে নেব। এই পরে আর কখনো আসে না। এক বছর পরও বলে, অন্যভাবে নেব, অন্য স্টাইলে নেব। আর নিলেও পরে ডিসকাউন্ট চায়।’

তিনি বলেন, ‘এখন বেশিরভাগ ক্রেতাই বলছেন, আপনাদের কাছে কাপড় থাকলে কাটবেন না, অথবা কাপড় কেটে ফেললে সেলাই করবেন না, আর সেলাই করে ফেললেও শিপমেন্ট করবেন না। এখনও কিন্তু ক্রেতারা ডাবল ডিজিটে প্রফিট করেন। এখনও কিন্তু তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় না। তারা যদি এখন এগুলো স্থগিত রাখতে বলেন, তাহলে আমাদের বেতন দেয়া, বোনাস দেয়া, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির পেমেন্ট করা, এগুলো সব আটকে যাবে। প্রচ- ক্যাশ ফ্লো’র ক্রাইসিসে পড়ব। ভয়াবহ সময় যাচ্ছে আসলে। আরেক প্রশ্নের উত্তরে ড. রুবানা বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের নীতি সহায়তা প্রয়োজন আছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, যেভাবে সম্ভব সহায়তা করবেন। ক্যাশ ফ্লো ক্রাইসিস সামলানোর মতো ক্ষমতা আমাদের কারও নেই। কারণ এটা সম্ভব না। মিয়ানমার, কম্বোডিয়া শ্রমিক ছাঁটাই করছে। কিন্তু আমরা শ্রমিক ছাঁটাই করব না। কারণ আমার শ্রমিক আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই শ্রমিকের কথা চিন্তা করে আমাদের প্রতিটি ক্রেতাকে বলছি, দয়া করে কোন অর্ডার আপনারা বাতিল করবেন না। পরে আপনারা ইনভেন্টরি এ্যাডজাস্ট করবেন। এখন এই মুহূর্তে তারা ক্রয় আদেশ বাতিল করতে শুরু করলে বা শিপমেন্ট করতে না দিলে সামনে বেতন-বোনাস দেয়ার ক্ষেত্রে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যাব।

দেশের নিট গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাতে সঙ্কট আরও গভীর হচ্ছে। আমরা আগে বলেছিলাম চীন থেকে উপকরণ আমদানি বন্ধ থাকায় এক থেকে দেড় মাসের জন্য হয়তো একটা ধাক্কা খাব। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা মহাসঙ্কট তৈরি করবে। নিটের ৭০ শতাংশ পণ্য ইউরোপে রফতানি হয়। সেখানে দোকানপাট বন্ধ। ক্রেতারা বিদ্যমান অর্ডার স্থগিত করার কথা বলছে। আর নতুন করে কোন অর্ডার তো নেই-ই। সামনে রোজা, ঈদ। রোজাই এমনিতেই আমাদের খরচ বেশি হয়। উৎপাদনও কম হয়। সবমিলিয়ে আমরা মহাসঙ্কটের শঙ্কায় আছি।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। সেখানের সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারও করোনা মোকাবেলায় বিশেষ ফান্ড গঠন করেছে। সরকারের কাছে আমরা অনুরোধ করেছি একটি বিশেষ ফান্ড গঠনের জন্য, যেখান থেকে এক বছরের জন্য বিনাসুদে ঋণ নেয়া যাবে। এছাড়া সরকার বিদ্যুতের খরচ বাড়িয়েছে। আমাদের দাবি, এখনই যেন তা বাস্তবায়ন না করা হয়।

তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক ও সফটটেক্স সোয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান সেলিম বলেন, পোশাক খাত নিয়ে ভবিষ্যত ভাল দেখছি না। আগামী দুই তিন মাস খুবই শঙ্কার। চীন উপকরণ রফতানিতে দুই সপ্তাহ দেরি করায় অনেক কোম্পানিতে উৎপাদন হয়তো দুই সপ্তাহ দেরি হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় শঙ্কা, ইউরোপ এখন ক্রেতাশূন্য। শপিংমল ও পোশাকের দোকানগুলো তাদের পণ্যে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে, কিন্তু ক্রেতা পাচ্ছে না। ক্রেতা না থাকলে তারা পণ্য নেবে না। আর তারা পণ্য না নিলে বা নিতে দেরি করলে আমরা মহাবিপদে পড়ে যাব। শ্রমিকদের বেতন দিতে পারব না। সামনে আবার ঈদ। শিপমেন্ট না হলে শ্রমিকদের বোনাসও দিতে পারব না। কিছু অর্ডার অন্য দেশেও চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কিছু কিছু কারখানায় প্রাথমিক উপকরণের অভাব দেখা দিয়েছিল। এর ফলে ঠিকমতো পোশাক পণ্য উৎপাদন করা যায়নি। বিষয়টি এখনও পুরো ঠিক হয়নি। এখন আবার করোনা ইউরোপে ছড়াচ্ছে। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যাতায়াত কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রফতানিতে বিরাট প্রভাব পড়বে। রফতানি আয়ও বিপদের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছি। কিছু কিছু অর্ডার ড্রপ করছে। সারাবিশ্বে এখন পোশাকের ক্রেতা কমে যাচ্ছে, বিক্রি কমে যাবে, কারণ কোন জায়গায় মানুষ এখন বের হতে পারছে না।

করোনার প্রভাবে ইতোমধ্যে দেশের রফতানি আয়ে বড় ধস দেখা দিয়েছে। মূলত রফতানি আয়ের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগই আসে পোশাক খাত থেকে। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম আট মাসে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। একইসঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। রফতানি ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা, কোনটাই স্পর্শ করতে পারেনি দেশের তৈরি পোশাক খাত।

খাত সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী তৈরি হওয়ায় আয় কমছে। এর পেছনে কম মূল্যে অর্ডার নেয়ার বিষয়টিও ভূমিকা রেখেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী করছেন করোনাভাইরাসকে।

রফতানিতে মন্দার এই সময়ে দেশে পণ্য আমদানিও কমেছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ৬১২ কোটি ১০ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা ৫৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে আমদানি কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ।

পণ্য আমদানি কমার পেছনেও করোনার প্রভাব দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ দেশে পণ্য আমদানির বড় অংশটিই পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এ খাতের আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়, যা গোটা আমদানি খাতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পরিস্থিতির উত্তরণ না ঘটলে ভবিষ্যতে পোশাক পণ্য আমদানি ও রফতানি, দুটোই আরও কমার ইঙ্গিত মিলছে পোশাক মালিক ও অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যে। সুত্র-জনকন্ঠ