নভেল করোনাভাইরাস

ভয়-আতঙ্ক নিয়েই কারখানায় যাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৩-২৩ ০৯:১১:১২


চীন খেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই সুরক্ষা ব্যবস্থা রেখে কলকারখানা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকার ও মালিকপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের কারণে শ্রমিকরাও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। তবে অনেকটা ভয়ে ভয়ে কারখানায় যাচ্ছেন তারা।

আশুলিয়ার এক সিরামিক কারখানার শ্রমিক শিল্পা। করোনা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যেও নিয়মিত কাজে যাচ্ছেন তিনি। সতর্কতার অংশ হিসেবে মূল ফটক পেরিয়ে হাত পরিষ্কার করে এবং মাস্ক পরে কারখানায় প্রবেশ করেন এ কর্মী। সতর্কতামূলক এ সুরক্ষা ব্যবস্থা তাকে সাময়িক স্বস্তি দিলেও করোনাভাইরাস ভীতি রয়েই গেছে তার। নিজের সুপারভাইজারকেও এই ভীতির কথা জানিয়েছেন শিল্পা।

শুধু শিল্পা নন, মনে ভয় নিয়েই কারখানায় আসছেন তার মতো হাজার হাজার শ্রমিক। তাদের কেউ পোশাক খাতে, কেউ সিরামিক খাতে, আবার অনেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানায় কাজ করছেন। মূলত একই ছাদের নিচে অনেক শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করার ফলে শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকের মধ্যে করোনা ভীতিটা অন্যদের তুলনায় বেশিই।

দেশের সিরামিক খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ফার সিরামিকস লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের কারখানায় কাজ করেন প্রায় ১ হাজার ৩০০ শ্রমিক। করোনাভাইরাসের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ায় কারখানাটিতে প্রবেশের আগে এখন হাত পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করতে হয়। আছে শ্রমিকের তাপমাত্রা যাচাইয়ের থার্মাল স্ক্যানারও। কিন্তু এত সব উদ্যোগের পরও কিছু শ্রমিক করোনা ভীতির প্রভাবেই নিজ থেকে কাজে আসেননি।

শ্রমিকরা কাজে আসতে ভয় পাচ্ছেন, এ তথ্য সঠিক কিনা জানতে চাইলে ফার সিরামিকস লিমিটেডের পরিচালক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, এটা সত্য। আমরা কারখানায়ই করোনা প্রতিরোধে অনেক ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি তাপমাত্রা যাচাইয়ে থার্মাল স্ক্যানারও বসানো হয়েছে। কিন্তু সচেতনতামূলক এসব পদক্ষেপে হিতে বিপরীত হচ্ছে। সবাই মনে করছে, কারখানায় যদি থাকে তাহলে আমরা কী করব? আমার মধ্যে যদি সংক্রমণ হয়? আমরা তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির সুরক্ষা দিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করছি, কিন্তু তারা অনেক কিছু চিন্তা করেন না। এখনো আমরা শ্রমিকদের সচেতন করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বিভিন্ন এলাকা থেকে যারা আসেন তারা অনেকে ভয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। আমরা কারখানা এখনো সচল রেখেছি, কিন্তু কেউ যদি স্বেচ্ছায় না আসে তাহলে কী করার থাকতে পারে? এ ধরনের ঘটনা কিছু আছে আমাদের কারখানায়ও।

শুধু সিরামিক খাত নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব শিল্প খাতের শ্রমিকরাই এখন করোনাভাইরাসের ভয়ে সন্ত্রস্ত। ঢাকার পার্শ্ববর্তী আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে ছয় হাজারের বেশি শিল্প-কারখানা আছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কারখানা বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের। এছাড়া অন্যান্য শিল্পের মধ্যে আছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, সিরামিক, ফার্নিচার। সব মিলিয়ে এসব এলাকায় কর্মরত আছেন ৩৫ লক্ষাধিক শ্রমিক। এ শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে ভীতি বা আতঙ্ক থাকলেও তারা কাজে যোগ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিল্প এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে করোনার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি আবদুস সালাম বলেন, করোনা সম্পর্কে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি চলমান আছে। কোনো ধরনের অস্থিরতা শিল্প এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে নেই। তবে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে শ্রমিকদের মধ্যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা অস্বাভাবিক নয়।

কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে বলে জানিয়েছেন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্পসংশ্লিষ্টরাও। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা শ্রমিকদের ভীতির বিষয়টি অস্বীকার করেননি।

এলএফএমইএবি সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের ব্যাপ্তি যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, এটা নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে একটা উদ্বেগ তো আছেই। এই বিষয়টি নিয়ে ভয় না পাওয়াটাই অস্বাভাবিক। তবে এ ভীতিকে আমি সচেতনতার প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এ ধরনের সময়ে কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের যোগাযোগ আরো বাড়িয়ে দিতে হবে। আমার অনুরোধ থাকবে, মালিকরা যেন নিজে কারখানায় উপস্থিত হন। তাহলে শ্রমিকরাও আশ্বস্ত থাকবেন যে আমার কারখানা নিরাপদ। আমরা মনে করি, শ্রমিকদের আবাসস্থলের চেয়ে আমাদের কারখানাগুলো অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ কমপ্লায়েন্স অনুসরণ করাসহ বর্তমানে করোনা প্রেক্ষাপটে কারখানাগুলো স্বাস্থ্যকর। আবাসস্থলের চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখার কর্মসূচি প্রতিনিয়ত চলমান থাকে কারখানায়। তার পরও শ্রমিকরা শঙ্কার মধ্যে আছেন করোনা ব্যাপ্তির সার্বিক প্রেক্ষাপটে।

ভয়ের বিষয়টি যৌক্তিক ও অত্যন্ত স্বাভাবিক হলেও পেটের দায়ে ঝুঁকি নিয়েই শ্রমিকরা এখনো কাজে নিয়মিতই যোগ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন শ্রমিক প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, শ্রমিকদের আয়ের উৎস শুধু মাস শেষে পাওয়া বেতন। কাজে না এলে অপ্রতুল ওই বেতনও পাবেন না। তখন তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের কী হবে, এসব বিবেচনায় নিয়েই ভয় সত্ত্বেও কাজ করতে কারখানায় যাচ্ছেন শ্রমিকরা।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়নের বাংলাদেশ অংশের কেন্দ্রীয় নেতা তৌহিদুর রহমান বলেন, শ্রমিকরা ভীত, তার পরও কারখানায় যাচ্ছেন। কারণ তিনি জানেন যে অনুপস্থিত থাকলে বেতন হবে না। বেতন না পেলে চলবে কী করে? এ অবস্থায় তারা বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। শ্রমিকরা তাদের ভীতি আমাদের কাছে প্রকাশ করার পাশাপাশি এ তথ্যও বলছেন যে কারখানায় পরিচ্ছন্ন থাকার যে কর্মসূচি সেগুলো অপর্যাপ্ত। বেতনসহ কারখানা ছুটি দিলে তারা স্বস্তি পেতেন।

এদিকে শ্রমিকরা কাজে আসতে ভয় পেলেও এ মুহূর্তে কলকারখানা সচল রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা। করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলায় গতকাল শ্রম ভবনের সম্মেলন কক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সঙ্গে জরুরি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কলকারখানা সচল রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় বলছে, এ মুহূর্তে কলকারখানা বন্ধ না করে সম্মিলিত টাস্কফোর্স গঠন, রেশনিং ব্যবস্থা, থোক বরাদ্দ, কলকারখানার ভেতরে-বাইরে স্বাস্থ্যবিষয়ক নিরাপত্তা জোরদার, প্রতিটি কারখানায় ডাক্তারের ব্যবস্থা, শ্রমঘন এলাকাভিত্তিক কোয়ারেন্টিন এবং প্রয়োজনে সরকার মালিক শ্রমিক এবং ক্রেতাগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠকের পরামর্শ দিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।

এদিকে শ্রম পরিস্থিতি সম্পর্কে গার্মেন্টসের ৭২টি শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও গতকাল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিভিন্ন গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের মতামত নেয়া হয়। সেখানে অধিকাংশ শ্রমিক নেতা কারখানা চালু রেখে করোনা প্রতিরোধে শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করার দাবি জানান বলে জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, পোশাক শিল্পে করোনার প্রভাবে নানা রকম কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ থেকে শ্রমিকরা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন। কিন্তু শ্রমিকদের কথা হলো কারখানা বন্ধ হলে খাব কী? কী করব? এটা শ্রমিকদের জন্য কঠিন বাস্তবতা। ভয় পেলেও টিকে থাকার জন্য ভয়কে তোয়াক্কা করছেন না তারা। নিজের কথা শ্রমিক হয়তো না ভাবতেই পারেন, কিন্তু পরিবারের কথা তাকে ভাবতেই হবে। আর যে পরিমাণ অর্ডার ক্যানসেল হয়েছে তাতে করে শ্রমিক নিজের কাজের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভীত। একদিকে ভবিষ্যৎ কাজের অনিশ্চয়তা, আবার আরেক দিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ পরিস্থিতিতে উভয় সংকটে রয়েছেন শ্রমিকরা। তাই ভয়ভীতি থাকলেও তা নিয়েই কাজে যোগ দিচ্ছেন তারা।