মহামারি করোনা সংকট
৮৪% পোশাক রফতানি কমেছে ১৫ দিনে
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-১৭ ০৭:০৩:৩৩
প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের কারনে থমকে গেছে পুরো বিশ্ব।থমকে গেছে দেশের অর্থনীতির চাকা।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী প্রায় সব দেশই এখন আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ লকডাউনে। এ অবস্থায় স্থবির হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকও। এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে খাতটির শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিসংখ্যানে। সংগঠনটি জানিয়েছে, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানি হ্রাস পেয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশে বাংলাদেশের বৃহৎ রফতানি গন্তব্য প্রায় প্রতিটি দেশেই এখন কভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আংশিক বা পূর্ণ লকডাউনে রয়েছে প্রায় সব দেশ। বাংলাদেশেও অঘোষিত লকডাউন চলছে গত ২৬ মার্চ থেকে। একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার কারণে দেশের রফতানি কার্যক্রম বর্তমানে স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি ধারাবাহিকভাবেই কমছে। গত মাসেও বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। রফতানিতে পতনের এ ধারাবাহিকতা বজায় ছিল এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনেও।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বিজিএমইএ জানিয়েছে, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে (১-১৫ এপ্রিল) বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ১৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। অন্যদিকে গত বছরের ১-১৫ এপ্রিলের মধ্যে পণ্যটি রফতানি হয়েছিল ১১৯ কোটি ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ডলারের। অর্থাৎ পণ্যটির রফতানি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৯ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার মূল্যের। সে হিসাবে পণ্যটির রফতানি হ্রাস পেয়েছে ৮৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
চীনের উহানে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় গত ডিসেম্বরের শেষে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে জানুয়ারি থেকেই দেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নিম্নমুখিতা বজায় রয়েছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত প্রথমে কাঁচামালের সরবরাহ সংকটে পড়ে যায়। চীনে নভেল করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের কারণে দেশটি থেকে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়। দেশে তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্যের আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। আর নিট পণ্যের কাঁচামাল আমদানি হয় ১৫-২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ধীরগতিতে হলেও কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু পরে রফতানি গন্তব্যগুলোয় এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ায় চাহিদার সংকট তৈরি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করতে থাকে একের পর এক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
সূত্রমতে, ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও আছে। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক প্রাইমার্কের পাশাপাশি ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের ক্রেতাই ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। আবার এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কিয়াবি, টার্গেট, পিভিএইচসহ আরো কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ বহাল রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিতের পরিমাণ কমে আসতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
এ ব্যাপারে বিজিএমইএর তথ্য বলছে, গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত ১ হাজার ১৪০ কারখানার মোট ৩১৬ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। এসব ক্রয়াদেশের আওতায় ছিল ৯৭ কোটি ৯০ লাখ পিস পোশাক। অন্যদিকে এসব কারখানার কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লাখ ৬০ হাজার।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই পোশাক রফতানির পরিস্থিতি টালমাটাল ছিল। ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ প্রাপ্তির পরিমাণও ছিল তুলনামূলক কম। ক্রয়াদেশ যতটুকু দেয়া হচ্ছিল, সেগুলোর দামও পাওয়া যাচ্ছিল কম। এ প্রবণতা ইউরোপের বাজারগুলোতেই তুলনামূলক বেশি। আবার এসব বাজারের ভোক্তা আচরণেও বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এখন। এ অবস্থায় দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওপর বড় ধরনের আঘাত হয়ে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে কভিড-১৯-এর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, পোশাক রফতানি পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে পোশাক খাতের অবস্থা কতটা নাজুক। সংকট এখনো চলমান।
চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) শুরু থেকেই রফতানি নিয়ে কিছুটা খারাপ সময় পার করছিল তৈরি পোশাক খাত। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) পোশাক রফতানি বেড়েছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পরের মাসেই বড় ধরনের পতন হয় পোশাক রফতানির। সে সময় রফতানি হ্রাস পেয়েছিল ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। রফতানিতে এ নেতিবাচক ধারা বজায় থাকে নভেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে তৈরি পোশাকের রফতানি হ্রাস পেয়েছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ১৯ দশমিক ৭৯ ও ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
এরপর ডিসেম্বরে কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসে তৈরি পোশাক রফতানি। ওই সময় বাংলাদেশ থেকে পণ্যটির রফতানি বেড়েছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ধসের ধারায়ই রয়েছে তৈরি পোশাক রফতানি। এর মধ্যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে তৈরি পোশাক রফতানি কমেছে যথাক্রমে ২ দশমিক ৯৮ ও ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এদিকে চলতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে পোশাক রফতানি ৫০০ কোটি ডলার হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিজিএমইএ। সংগঠনটির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি হবে ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। যেখানে গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৮৬০ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এ হিসাবে তিন মাসের সম্মিলিত রফতানি হ্রাস পেতে যাচ্ছে ৪৯০ কোটি ডলার বা ৫৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।