দায়িত্ব পালন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
এক লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-২৩ ০৭:৫১:১৩
মহামারি করোনাভাইরাসের কারনে আর্থিক খাতে চরম সংকট দেখা দিয়েছে।করোনার এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এক লাখ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়েছে। পুরো প্যাকেজটি বাস্তবায়নে অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা দেয়ার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত নীতিমালা ও একটি গাইড লাইন তৈরি করছে। প্যাকেজটি দ্রুত বাস্তবায়ন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি দেখভাল করবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ইতোমধ্যে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের আগামী তিন মাসের বেতন প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত সব নিয়ন অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সুনির্দিষ্ট ব্যাংকে এই টাকা স্থানান্তর করবে। শ্রমিকরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আগামী ৩০ এপ্রিল থেকে এই টাকা ঘরে বসেই পাবেন।
এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত এক লাখ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি একটি যুগান্তকারী, সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ। এই প্যাকেজ বাস্তবায়ন করে দেশের অর্থনীতি আবার চাঙ্গা করা হবে। বিশেষ করে স্বল্প ও দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় জোরালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এই প্রণোদনা। এলক্ষে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ৫ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষি খাত উন্নয়নে বাজেটে বড় অঙ্কের যে ভর্তুকি দেয়া হয় তা অব্যাহত রাখা হবে আগামী বাজেটে। এছাড়া বৃহৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এই প্যাকেজের আওতায় নামমাত্র সুদে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ পাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ানো হবে। অর্থ বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দেশের অর্থনীতিকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন হওয়াটা জরুরি। এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, চাপ পড়বে ব্যাংকিং খাতের ওপর। এ কারণে একটি সমন্বিত উদ্যোগে প্রণোদনা প্যাকেজটি বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন,করোনা সংকটকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করা হয়েছে। মানুষের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। করোনায় দেশের একটি মানুষ যাতে না খেয়ে মারা না যায় সেদিকে সরকারের লক্ষ্য রয়েছে। এর পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, করোনার কারণে ইতোমধ্যে দেশের সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ পান সেদিকে নজর রাখছে সরকার। শুধু তাই নয়, করোনা মোকাবেলায় এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করে অর্থনীতিকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। ইতোমধ্যে দাতা সংস্থাগুলোর নির্দিষ্ট বরাদ্দের পাশাপাশি অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের পাশাপাশি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করা হয়েছে। রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য তিন মাসের বেতন প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো টাকা নেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এছাড়া ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার মধ্যে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হবে। এই অর্থ শিল্পমালিকরা তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পেয়ে যাবেন। আবেদন থেকে শুরু করে ঋণ পাওয়া সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে যত চ্যালেঞ্জ থাকুক কেন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা এপ্রিল মাস থেকেই প্রণোদনা হতে বেতনভাতা পাবেন। আর কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেলে ব্যাংক থেকে ঋণ পাবেন শিল্পোদ্যোক্তারা। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণোদনা ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সুদ ও ভর্তুকি দিতে প্রস্তুত রয়েছে। সুদ ও ভর্তুকি খাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কত টাকা গুনতে হবে তার একটি হিসেবেও করে রাখা হয়েছে।
প্রণোদনা থেকে শিল্পঋণ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা, প্রি–শিপমেন্ট ক্রেডিট রেফারেন্স স্কিম নামে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা ও রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন–ভাতা পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকাসহ ২১ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দেয়া হয়। প্যাকেজ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্যও কাজ শুরু করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)সহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছেন।
এই অর্থায়ন প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাজেট) সিরাজুন নুর চৌধুরী বলেন, করোনার কারণে এ বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পুরোপুরি বাস্তবায়নে চাপ তৈরি হবে। ফলে এডিপির বেঁচে যাওয়া অর্থ প্যাকেজের অর্থায়নের একটি বড় উৎস হতে পারে। পাশাপাশি বৈদেশিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল থেকেও প্যাকেজ বাস্তবায়নে ফান্ড গঠন করবে। এসব উদ্যোগের ফলে অর্থায়ন নিয়ে তেমন কোন সমস্যা তৈরি হবে না।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৩ বছরের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে এ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় প্রণোদনা প্যাকেজ। এত বড় প্রণোদনা থেকে সাধারণ মানুষ কিভাবে উপকৃত হবে তা নির্ধারণ করা একটি কঠিন বিষয়। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের সঙ্গে ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন তাঁতি, কুমার, বুটিক, ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সংখ্যা কম নয়। যাদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্যাকেজের দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলোর জন্য সহায়তা, আরেকটি হচ্ছে দরিদ্র এবং অসহায় জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংকট ও অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, পৃথিবীব্যাপী করোনা সঙ্কটে অর্থনীতির গতি থমকে গেছে। দেশের প্রায় সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করোনার ধাক্কায়। তবে সঙ্কট উত্তরণে সরকার এরই মধ্যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তবে এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা অসম্ভব নয়। আশা করছি প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
প্রণোদনা প্যাকেজে কৃষকদের জন্য ৪ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। করোনায় অনেক কৃষকের ক্ষতি হয়েছে। মূলধনের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারবেন না অনেক কৃষক। তাদের জন্য এ প্যাকেজ সুবিধা দেয়া হয়। এ প্যাকেজ বাস্তবায়ন হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার হবে, বাড়বে কৃষির উৎপাদন। তবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা এ প্রণোদনা প্যাকেজকে সাধুবাদ জানালেও প্যাকেজের সুবিধা কোনো ধরনের মধ্যস্থতা ছাড়া সরাসরি তাদের হাতে পৌঁছবে কিনা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, কৃষি খাতে ৪ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষির সব সেক্টরে (মৎস্য ও প্রাণী খাতসহ) সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হবে। করোনাকালীন সাধারণ ছুটির সময় কৃষি কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে মন্ত্রণালয়াধীন সব কর্মকর্তাকে নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের নিয়মিত মাঠে গিয়ে এ দুর্যোগময় অবস্থায় কৃষকের পাশে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সূত্র:জনকন্ঠ