করোনায় ইউএসডিএর পূর্বাভাস
উৎপাদনের সাথে ভোগের চাপও বাড়বে বাংলাদেশ
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-৩০ ০৮:৩৯:১৬
দেশে চলমান বোরো মৌসুম শেষে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তির দিকে থাকতে পারে। এসময় আবহাওয়া অনুকূল থাকলে বাড়তি প্রায় সাড়ে চার লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে এ বছর। সেই সঙ্গে কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দানাদার খাদ্য, বিশেষ করে চাল ভোগের পরিমাণও বাড়বে। ফলে উৎপাদন বাড়লেও ভোগের চাপ থাকবে। বাংলাদেশের খাদ্য ও কৃষি পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য নিয়ে এক প্রতিবেদনে এ পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ ইউএসডিএ।
বৈদেশিক কৃষিসেবার আওতায় গ্লোবাল এগ্রিকালচার ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (জিএআইএন) শীর্ষক ওই প্রতিবেদনটি বুধবার প্রকাশ করে ইউএসডিএ। প্রতিবেদনে বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য পরিস্থিতির নানা সূচকের তুলনা করা হয়েছে, যাতে বেশকিছু সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ‘বেশ ভালো’ বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এবার ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়তে পারে। চলতি বোরো মৌসুম শেষে আবাদ ১ কোটি ১৮ লাখ হেক্টর এবং উৎপাদন ৩ কোটি ৬৩ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে বোরোর উৎপাদন হতে পারে ১ কোটি ৯৫ লাখ টন, যা গত মৌসুমের তুলনায় ১ লাখ টন বেশি। অন্যদিকে আউশ উৎপাদন ২৪ লাখ ৫০ হাজার টন থেকে দেড় লাখ টন বেড়ে ২৬ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। এছাড়া আমনের উৎপাদন ১ কোটি ৪০ লাখ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। সব মিলিয়ে চলতি বছর চাল উৎপাদন ৪ লাখ ৫০ হাজার টন বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ইউএসডিএ।
শুধু চাল নয়, এ বছর গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য দানা শস্য কেমন উৎপাদন হতে পারে তার পূর্বাভাসও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ। ইউএসডিএ বলছে, চলতি মৌসুমে ৩ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন গম উৎপাদন হতে পারে। তবে গম ও ভুট্টাসহ কর্নজাতীয় শস্যের আবাদ হতে পারে ৫ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন দাঁড়াবে ৫১ লাখ টন।
উৎপাদনের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে দানাদার খাদ্যশস্যের আমদানি ১০ লাখ টন কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে ইউএসডিএ। যদিও এ সময়ে চালের আমদানি কিছুটা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ইউএসডিএ বলছে, চালের আমদানি বাড়াতে হতে পারে, কারণ করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ও ব্যক্তি চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি মৌসুমে দেশে ৩ কোটি ৬৩ লাখ টন চালের ভোগ হতে পারে। বাজারে চালের ভোগের পরিমাণ বাড়াবে সরকারের প্রয়োজনীয়তা। কারণ কভিড-১৯ মোকাবেলা করার জন্য খোলা বাজার থেকে সরকারকে চাল কিনতে হবে। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর চাল বিতরণ কার্যক্রমও বাজারে চালের বাড়তি চাহিদা তৈরি করবে। সরকারের ভর্তুকি মূল্যে চাল বিতরণ কর্মসূচির কারণে বেশি পরিমাণ চালের মজুদ করতে হতে পারে। এরই মধ্যে ১০ টাকায় খোলা বাজারে চাল বিতরণ কার্যক্রম চলছে। এছাড়া রাইস ব্র্যান অয়েল ও খাদ্য উৎপাদন খাতেও চালের চাহিদা তৈরি হবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে জরুরি ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকার এরই মধ্যে ৫ লাখ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। এসব চাল স্থানীয় বাজার থেকেই সংগ্রহ করা হবে।
দেশের কৃষির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। কৃষকের জন্য আর্থিক প্রণোদনা থেকে শুরু করে বিপণন, সরবরাহ ও উপকরণের সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের খাদ্যশস্যের চাহিদা নিজেদের উৎপাদনের মাধ্যমেই পূরণ করতে হবে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে বোরো ধানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সারা বছরের মোটা চাল উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি জোগান দেয় বোরো ধান। সারা দেশের ফসল সুষ্ঠুভাবে ঘরে তোলা জরুরি। এটি করতে পারলে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা অনেকাংশে নিশ্চিত হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সামনের মৌসুমে যেসব শস্য আবাদ হবে সেগুলোতে সর্বাধিক গুরুত্ব ও সতর্কতার সঙ্গে উৎপাদন করা হবে। অনুকূল আবহাওয়া পেলে দানাদার খাদ্যশস্যের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবেন দেশের কৃষক।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে খাদ্যশস্যের মজুদ নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ২৪ মার্চ পর্যন্ত সরকারের কাছে চালের মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৯০ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি। মূলত আমন ধানের বাম্পার ফলন এবং এ মৌসুমে সরকারের ভালো সংগ্রহ হওয়ার কারণে এ সফলতা অর্জিত হয়েছে। এছাড়া গমের মজুদ রয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার টন। সব মিলিয়ে খাদ্যশস্য বিশেষ করে চাল ও গমের মজুদ রয়েছে ১৬ লাখ ৯৫ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২ লাখ ১ হাজার টন বেশি।
এদিকে চলতি বোরো মৌসুমে সরকারের ধান, চাল ও গম সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। ফলে মজুদের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। মজুদ একটি শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারে। তবে সেই মজুদ নিয়ে ঝুঁকিও রয়েছে। কেননা সরকারের বিভিন্ন খাদ্যসহায়তা কর্মসূচিতে অধিক পরিমাণে চাল ও গম বিতরণ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সামনের দিনে সরকারের বিতরণ কর্মসূচিতে সেটি আরো বাড়তে পারে।
মজুদ পরিস্থিতি আগের বছরের তুলনায় ভালো থাকলেও সতর্ক ও দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক খাদ্য সচিব আনোয়ার ফারুক। তিনি বলেন, উৎপাদন ও খাদ্যশস্যের মজুদ এখনো সন্তোষজনক। তবে এ পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে যদি আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করে। তাছাড়া করোনা আরো দীর্ঘকাল অবস্থান করলে কী ধরনের খাদ্যশস্য প্রয়োজন হবে, সেটি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চাল ও গম রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।