‘শেখ হাসিনা ও তার দলের পতন ঘটবে কম সময়ের মধ্যেই’
আপডেট: ২০১৫-১২-০৫ ২১:০৮:৩৭
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি ভবিষ্যতবাণী নিশ্চিত, তাতে শেখ হাসিনা ও তার দলের কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে এবং সেটা তাদের প্রত্যাশারও কম সময়ে ঘটবে। সেটা হতে পারে বিরুদ্ধ মতবাদের দরজা বন্ধ থেকে ইসলামী গ্রুপের উত্থান থেকে। অথবা আর্মি নতুন করে ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। এগুলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশকে বিলম্বিত করবে। কলকাতার দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকায় উপ-সম্পাদকীয়তে ৩ ডিসেম্বর এ ধরনের মন্তব্য ছাপা হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর আলী রিয়াজের ফেসবুক পোষ্টে বলা হয়েছে: ‘লেট আস রিড দ্য অপ-এড পিস বাই রামচন্দ্র গুহ, ইন্ডিয়ান হিস্টোরিয়ান উইথ এন ইমপেকাবল একাডেমিক রেকর্ড’। অর্থাৎ আসুন, নিখুঁত শিক্ষাবিষয়ক কৃতিত্বের অধিকারী ভারতীয় ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহের উপ-সম্পাদকীয়টি পড়ি। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার বিষয়ক ডক্টর তাজ হাশমী তার ফেসবুকে টাইটেলটি তুলে ধরে পোষ্ট দিয়েছেন।
সেই উপ-সম্পাদকীয়টি ৩ ডিসেম্বর কলকাতার দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মূল শিরোনাম: ‘টু কোয়ায়েট টু কমফোর্ট – দ্য লুমিং পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ বা অস্বস্তিকর – বাংলাদেশের অনাগত রাজনৈতিক সংকট।
এখন প্রশ্ন হলো কী আছে সেই নিবন্ধে?
রামচন্দ্র গুহ শুরুতেই লিখেছেন, সত্তর ও আশির দশকের জনবিস্ফোরণে জর্জরিত বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল ‘বাস্কেট-কেস’ বা তলাহীন ঝুড়ি, যাকে পথ চলতে হয়েছে পশ্চিমের পাঠানো পর্যায়ক্রমিক গেমে। জেরেট হার্ডিনের মতো প্রভাবশালী জীববিজ্ঞানীরা সেই সাহায্য বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন, যাতে বাংলাদেশের মৃত্যু ঘটে, সম্ভবত সেটাই তাদের নিয়তি ছিল।
এরপরই রামচন্দ্র গুহ তার উপ-সম্পাদকীয়তে ধাপে ধাপে লিখেছেন, বাংলাদেশের আম-জনতা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো জার্নাল পড়েনি, যেখানে জীববিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদীরা তাদের ভবিষ্যতবাণী দেন। তারা তাদের নতুন অর্জিত রাষ্ট্র বিনির্মাণে মন দিয়েছিল। ২৮ নভেম্বর টেলিগ্রাফে মুদ্রিত আগের নিবন্ধে বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের মানুষের চমকপ্রদ সাফল্য তুলে ধরেছি। তারা ভারতের চেয়েও উৎপন্ন শিল্প ছাড়াও নারী অধিকার বাস্তবায়নে নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে বিস্ময়করভাবে কাজে লাগিয়েছে।
গৃহযুদ্ধ, সাইক্লোন ও উপদলীয় রাজনীতির প্রকোপ থেকে বিকশিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সে কারণে গুরুত্ববহ। তা সত্ত্বেও যা উদ্বেগের তা রাজনৈতিক ফ্রন্টে অনগ্রসরতা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের একমাত্র কারণটি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা কোনো জায়গা দিতে চায়নি। এখন নিয়তির পরিহাসটি হচ্ছে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রে আওয়ামী লীগই সেই অবস্থানে উপনীত।
বাংলাদেশের রাজনীতি সব সময়ই দুর্গম। একাত্তর পরবর্তী সরকার পরিচালনা করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়ামী লীগের কর্ণধার শেখ মুজিবুর রহমান। পঁচাত্তরে মুজিব রাজনীতিতে এক-দলীয় শাসন কায়েমের কর্মযজ্ঞ সাধন করেন। অনেক বিরোধী রাজনীতিক কারাবন্দি হন। জনরোষ সৃষ্টি হয়, অবশেষে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটে, জুনিয়র অফিসাররা মুজিবকে খুন করে এবং সরকারের কর্তৃত্ব সিনিয়রদের নেতৃত্বদানকারী জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
১৯৮১ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকেন, তার নিহত হওয়ার পর জেনারেল এইচ এম এরশাদ ক্ষমতাসীন হন। প্রায় এক দশক এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন। তারপর লাগাতার বিক্ষোভ শেষে ১৯৯১ সালে নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বিধবা পত্নী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টি জয়লাভ করে। পাঁচ বছর পর মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ব্যালট-বাক্সের লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন হন। ২০০১ সালে বিএনপি ফিরে আসে এবং ২০০৬ সাল নাগাদ ক্ষমতায় থাকে। এ সময় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়।
২০১৩ সালের নির্ধারিত নির্বাচনের আগে বিএনপির দাবি ছিল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে আওয়ামী যেন ক্ষমতা হস্তান্তর করে যাতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়। আওয়ামী লীগ তা মেনে নেয়নি; ফলে বিএনপি ও অপরাপর বিরোধী দল সেই নির্বাচন বয়কট করে। সেই থেকে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার, পার্লামেন্ট ও প্রশাসনের কর্তৃত্ব ‘আনট্রামেল্ড’ বা বাধাহীনভাবে করায়ত্ত করেছে।
সর্বশেষ তার শাসনামলে শেখ হাসিনা বলিষ্ঠভাবেই ১৯৭১ সালে সাধারণ মানুষের উপর পরিচালিত যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত পাকিন্তানের সমর্থনকারীদের বিচার পরিচালনা করছেন। নভেম্বরের শেষে ঢাকা থাকাকালীন দেখেছি দুজন সিনিয়র রাজনীতিককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। একজন ধর্মীয় গ্রুপ জামায়াতে ইসলামীর নেতা, যারা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছে। আরেকজন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রভাবশালী পাকিস্তানপত্নী রাজনীতিকের সন্তান এবং বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির উপদেষ্টা।
একদিন পর বেগম জিয়া দীর্ঘদিন বিদেশ কাটিয়ে ঢাকা ফিরে আসেন। পরদিনই জামায়াত দেশব্যাপি হরতাল ডাকে। অতীতে দেখা গেছে সেই সংহতিতে বন্ধ দোকানপাট ও শূন্য রাজপথে নেমেছে বিএনপির হাজারো সমর্থক। এখন তাতে প্রাত্যহিক ঢাকার চিত্র বদলায় না। পুলিশ, প্যারামিলিটারি ও সামরিক বাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান। কোনো জনক্ষোভের অনুমতি বা অনুমোদন নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মি ভয়ঙ্কর অপরাধ সাধন করেছে, যাতে স্থানীয় দালালেরা সহযোগিতা জুগিয়েছে। তা সত্বেও এই বিচার পরিচালনা এবং পরিণতিতে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে মারাত্মক আপত্তি রয়েছে। এমনকি দুর্ভাবনাটি হচ্ছে এই বিচার পরিচালনায় রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যেভাবে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তার রাজনীতি ও মতবাদকে একীভূত করেছে। সেগুলো প্রণোদিত করছে বটে, কেননা পার্লামেন্টে কোনো বিরোধিতা নেই। আর সাংবাদিকেরা যারা যৌক্তিক সমালোচনা করছেন, তারাও জায়গামত নিগৃহীত হচ্ছেন। শিক্ষাবিদ যারা বাংলাদেশের বৃহত্তর গণতন্ত্রায়নের কথা ভাবেন, তারাও গালি খাচ্ছেন।
আজকের বাংলাদেশে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ‘হেলো’ বা চন্দ্রবলয় রয়েছে। অনেক ভারতীয় গান্ধীকে গান্ধী বলতে পারলেও মুজিবকে মুজিব বলতে পারার দৃষ্টান্ত সেখানে দুর্লভ। তিনি এককভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’, বাঙ্গালীর বন্ধু। সেই মুজিব দীর্ঘকাল পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। শেখ হাসিনার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিচালনা আংশিক, এমনকি পরিপূর্ণভাবেই তার পিতার প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা থেকে উৎসারিত। তারপরও বলা প্রয়োজন যেভাবে তার প্রশাসন কাজ করছে তাতে তার পিতার ‘ইগনোবল’ বা কদর্য সময়কালের ভয়ঙ্কর পরিণতির পানে ধাবিত হচ্ছে, আপাতদৃষ্টিতে যেখানে তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ১৯৭৫ সালের সূচনায় বিরোধিতাকে আইন বহির্ভূত করতে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপি ও জামায়াত পরাস্ত ও মনোবলহীন। ইতিমধ্যে দ্বিপাক্ষিক সুবিধার্থে আর্মির সঙ্গে প্রশাসন জোট বেঁধেছে। গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়নক হিসেবে আর্মিকে রাস্তা নির্মাণের চুক্তি দিয়েছে। এতে আর্মির শক্তিমত্তা বিপদ পরিসীমায় বিস্তৃত, যেমন- তা মতের অবাধ্য জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোকে টেলিকম কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করেছে।
ইতিহাসে শেখ হাসিনা এবং তার পরামর্শদাতারা এক-দলীয় সরকার হিসেবে যথাযথ স্থান করে নিতে পারবেন বটে, কেননা ব্যালট-বাক্সের মাধ্যমে তাদের উত্থান। নাৎসীরা ১২ বছরেরও কম সময় ক্ষমতায় ছিল, অথচ তাদের সমর্থকদের হাজার বছরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস, পাকিস্তানের পিপলস পার্টি এবং শ্রীলংকায় ফ্রিডম পার্টি – সবাই এক-পার্টির রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছে, কিন্তু কেউই কয়েক বছরের বেশি টেকেনি।
সে জন্যই এক-পার্টির রাষ্ট্রের ভাগ্যের পরিণতিতে রয়েছে ব্যর্থতা। কিন্তু যে সময়টায় তারা ক্ষমতায় থাকে ব্যাপক বিনাশ সাধন করে। ইন্ধিরা গান্ধি ও কংগ্রেস যেভাবে প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ক্ষতি সাধন করেছেন, তাতে আজো সেগুলো কার্যকর স্বায়ত্ত্বশাসন ফিরে পায়নি। তেমনিভাবে ভুট্টো ও পিপিপি আর্মিকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে ইসলামী মৌলবাদের বিকাশ ঘটিয়েছেন। মাহেন্দ্র রাজাপাকশে এবং এসএলএফপি ‘সিনহালা চৌভিনিশম’-কে বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম এবং অপরাপর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের চেয়েও ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন।
এছাড়া আজকের বাংলাদেশের অনেক কিছুই প্রশংসনীয়, যেমন- নারীর অগ্রগতি, উদ্যোক্তাদের সৃজনশীলতা, চমৎকার সুশীল সমাজ এবং তার ঐশ্বরিক চিত্রকর ও লেখকবৃন্দ। কিন্তু পরবর্তী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সরকারের স্বেচ্ছারিতা ও প্রতিহিংসা সমূহ বিপন্নতায় জড়িয়ে রয়েছে।
সূত্র: অনলাইন
সানবিডি/ঢাকা/রাআ