শেয়ারে ঝুঁকি কমানোর উপায়:শফিকুল ইসলাম
:: আপডেট: ২০২০-০৭-২৫ ১৫:৫৮:৪৫
‘কোন মার্কেটে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে সচেতন সবাই বলবে শেয়ার মার্কেট। এটাই বাস্তবতা যে বিশ্বব্যাপী স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ স্বীকৃত অন্য সকল বিনিয়োগের চেয়ে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে এটা আরো বেশী সত্য। তথাকথিত জুয়াড়ীদের তৎপরতায় সাধারন বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর ঝুঁকি এদেশের মার্কেটে সবসময়ই ছিল। তবে করোনা এসে সে ঝুঁকির মাত্রা সম্ভবত আকাশচূঁড়ায় নিয়ে গেছে।
এটা সর্বজনবিদিত যে নানা ধরনের সঞ্চয় স্কীম, এফডিআর, জমি, ফ্লাট ইত্যাদি সব রকম বিনিয়োগেই কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে। তবে সেসব ঝুঁকির চেয়ে সাধারনভাবে স্টক মার্কেটে ঝুঁকির পরিমাণ বেশী। কেন সেখানে এত ঝুঁকি? তার কারণ – শেয়ার কেনার পরেই তার দাম দ্রুত পড়ে যেতে পারে। আর যদি সে কোম্পানী দেউলিয়া হয়ে পড়ে তবে লিকুইডেশনে যাওয়ার পর সব দায়দেনা মিটিয়ে সবশেষে যা থাকবে তাই শুধু শেয়ারহোল্ডারদের প্রাপ্য। নানা অব্যবস্থাপনার ফলে যে কোম্পানী দেউলিয়া ঘোষিত হলো তার দেনা যে বেশী হবে তা বলাই বাহুল্য। তাই সব দায়দেনা মিটিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য তেমন কিছু যে অবশিষ্ট থাকবে না সে সত্য সবাই বুঝে। প্রশ্ন হলো এত ঝুঁকির পরও মানুষ কেন শেয়ারে বিনিয়োগ করে? সে প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে অতিরিক্ত লাভের আশা। স্টক মার্কেটে Risk বা ঝুঁকি যেমন বেশী Reward বা লাভও তেমন বেশী। এই Risk আর Reward এর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের কারণেই পৃথিবীতে শেয়ার মার্কেট টিকে আছে। আর ভবিষ্যতেও থাকবে।
স্টক মার্কেটে অনেকগুলো খাতের আওতাধীন নানাবিধ কোম্পানীর শেয়ার বেঁচাকেনা হয়ে থাকে। আবার আছে মূলধনের ভিত্তি বিবেচনায় ছোট, বড়, মাঝারী নানা সাইজের কোম্পানী। আছে মিউচুয়াল ফান্ড যাদের পেইড আপ ক্যাপিটালও বিভিন্ন সাইজের। সেসব মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করে আলাদা আলাদা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী যাদের পরিচালনা স্টাইলসহ অভিজ্ঞতা ও সততার মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। সংগত কারণেই খাতভেদে ঝুঁকির মাত্রা ভিন্ন। এমনকি একই খাতের আওতাধীন স্বল্পমূল্ধনী ও বৃহৎ কোম্পানীর মধ্যে ঝুঁকির মাত্রায় ব্যাপক পার্থক্য থাকে। কোম্পানীর স্পন্সরদের ইন্ট্রিগ্রিটি এবং ম্যানেজমেন্ট স্টাইলের উপরও ঝুঁকির মাত্রা নির্ভরশীল। কেউ হয়তো আয়ের বড় অংশ ল্ভ্যাংশ আকারে বিতরণ করে দেয়, আবার কেউ ল্ভ্যাংশ না দিয়ে বা কম দিয়ে তা রিজার্ভে জমা রেখে তা ব্যবসা সম্প্রসারণে খাটায়। কোন ম্যানেজমেন্ট হয়তো প্রচুর ব্যাংক ঋণ নেয়, আবার কেউ পারতপক্ষে ব্যাংক ঋণের ধারেকাছেও যায় না। সব মিলিয়ে স্টক মার্কেটে বহুমূখীতা ও ব্যাপক বৈচিত্র্য বিদ্যমান। এক কথায় বলা যায় যে এ মার্কেটে প্রতিটি কোম্পানীর শেয়ারে ঝুঁকির মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন।
উপরে বর্ণিত বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তিনি কতটা ঝুঁকি নিতে মানসিক ও আর্থিকভাবে প্রস্তত আছেন। ঝুঁকি গ্রহণের কাম্যতা একেকজনের জন্য একেক রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্ত প্রযোজ্য ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ আর তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোম্পানী চিহ্নিত করতে প্রয়োজন মার্কেট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ও অভিজ্ঞতা। বিনিয়োগকারী যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে কোন কোম্পানীর শেয়ারে কিরুপ ঝুঁকি রয়েছে তাহলে সে সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কোন কোম্পানীর শেয়ারে তার বিনিয়োগ করা সঠিক হবে কিংবা হবে না। শেয়ার মার্কেটের সকল কোম্পানীর দুই ধরণের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয় – মার্কেট ঝুঁকি এবং ইন্টারনাল ঝুঁকি। এটা সত্য যে সবসময়ই মার্কেট ঝুঁকি থাকবে যেটি বিনিয়োগকারীর নিয়ন্ত্রণে নয়। যেমন, করোনা ভাইরাসের ফলে বিশ্বব্যাপী সব স্টক মার্কেটে ভাল মন্দ নির্বিশেষে সব শেয়ারের দামের পতন হয়েছে। এরুপ মার্কেট ঝুঁকি এড়ানো না গেলেও সচেতনতা আর যথাযথ রিসার্চের সাহায্যে অন্ততঃ ইন্ট্রারনাল বা কোম্পানীর অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি কমাতে পারলেও তাই বা কম কিসের।
স্টক মার্কেটে বড় ধরনের ঝুঁকি পরিহার করে নিজের বিনিয়োগকে সুরক্ষিত ও লাভজনক করতে সাধারন
বিনিয়োগকারীগণ নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে পারেনঃ
(১) এ্যাসেট এলোকেশনের ক্ষেত্রে হাতে থাকা মোট অর্থের সবটুকু স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ না করে একটি পুর্বনির্ধারিত অংশ বন্ড বা এফডিআর এ বিনিয়োগ করতে হবে। তাছাড়া, স্টকে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের সবটুকু একসাথে বিনিয়োগ না করে সবসময় একাউন্টে কিছু নগদ অর্থ রাখতে হবে যাতে করে যখনই কোন বিশেষ ঘটনার ফলশ্রতিতে কাংখিত কোম্পানীর শেয়ারদামে পতন ঘটে তখনই তা কেনা সম্ভব হয়।
(২) কোম্পানীর ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি মানসম্পন্ন হলেই শুধুমাত্র বিনিয়োগ করা যাবে। ম্যানেজমেন্ট সৎ ও দক্ষ কিনা তা নানা বিষয়ে কোম্পানীর সিদ্ধান্ত এবং সেইসাথে কিছু রেশিও পর্যালোচনা করে বুঝা যায়। স্পন্সরদের শেয়ারহোল্ডিং বেশী থাকতে হবে, রিটার্ন অন ইক্যুইটির হার প্রতিযোগী কোম্পানীর তুলনায় ভাল হতে হবে, রিটার্ন অন রেভেনিউ সন্তোষজনক হতে হবে, ক্যাশ ডিভিডেন্ড ও স্টক ডিভিডেন্ড এর অনুপাত যথাযথ হতে হবে, এবং সর্বোপরি কোম্পানীর বার্ষিক রিপোর্ট স্বচ্ছ হতে হবে। যদি এসব ক্রাইটেরিয়া পূরণ হয় তবে ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটিসম্পন্ন বলে বিবেচিত হতে পারে। স্পন্সর পরিচালকদের শেয়ারহোল্ডিং ন্যুনতম ৩০% আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। যদি না থাকে তবে বুঝতে হবে সেটা রেড সিগন্যাল। সে বিষয়ে দু’টি কোম্পানীর উদাহরণ দেয়া যায়। আইটি সেক্টরের ইনটেক কোম্পানীর স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং ৪% এর নীচে। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানীটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত। কোম্পানীটি ২০০৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত শুধুই স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছে, কখনোই শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নগদ বা ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়নি। আবার ফুড এন্ড এলাইড সেক্টরের ফুওয়াং ফুডসের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং মাত্র ৮.৬২%। এ কোম্পানীটিও দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত। তারা ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিভিন্ন হারে শুধুই স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছে; শুধুমাত্র ২০১৯ সালে মাত্র ২% ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। আরো মজার বিষয় হলো ২০১৯ এ প্রদত্ত ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষনার সাথে কোম্পানীতে স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিংয়ের হার বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে বলেও অনেকে অভিযোগ করে। উল্লেখ্য, ডিএসই ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী ৩০ জুন ২০১৯ তারিখে উক্ত কোম্পানীতে স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং যেখানে ছিল মাত্র ৫.৩৬%, তা বর্তমান বছরের ৩১ জানুয়ারীতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৬২%।
(৩) স্বল্পমূলধনী কোম্পানী যাদের প্রাইস আর্নিং (পি-ই) রেশিও একই খাতের প্রতিযোগী অন্যান্য কোম্পানীর থেকে অনেক বেশী সেখানে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পি-ই রেশিও বেশী থাকার অর্থই হলো শেয়ারটির প্রতি জুয়াড়ী সিন্ডিকেটের নজর রয়েছে এবং তারা যে কোন সময় শেয়ার অফলোড করে মার্কেট থেকে বেরিয়ে যেতে পারে যখন সাধারন বিনিয়োগকারীরা উচ্চ দামে কেনা শেয়ার নিয়ে বিপদে পড়বে।
(৪) কোম্পানীর ঋণসীমা (Debt) নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। কিছু কিছু খাত আছে; যেমন- টেলিকমিউনিকেশন, পাওয়ার, ব্যাংকিং, ইত্যাদি খাত যেখানে ব্যবসা করতে প্রচুর অর্থের দরকার হয় যার ফলে শুধুমাত্র শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটি দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। সেসব খাতের কোম্পানীর বেলায় ঋণ থাকবে, তবে দেখতে হবে একই খাতের প্রতি্যোগী অন্যান্য কোম্পানীর তুলনায় তা বেশী রয়েছে কিনা। রিটার্ন অন ইক্যুইটি এবং সুদহারের মধ্যকার মার্জিন বা গ্যাপ কতটা আছে সেটাও দেখার বিষয়। রিটার্ন অন ইক্যুইটি সুদহারের চেয়ে অবশ্যই বেশী হতে হবে এবং তা যত বেশী থাকবে ততই নিরাপদ। সেক্ষেত্রে ব্যবসা্র সুসময়ে ঋণগ্রহণ কোম্পানীর ইপিএস বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে, যদিও তা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি বাড়ায়।
(৫) β এর মান কম দেখে শেয়ার দেখে শেয়ার কিনতে হবে। যেসব শেয়ারের β এর মান ১ এর নীচে শুধু সেখানেই বিনিয়োগ করা উচিত হবে, বিশেষতঃ সামগ্রিকভাবে মার্কেট যখন নিম্নগামী থাকে। β হচ্ছে মার্কেটের ইন্ডেক্স উঠানামার সাথে কোন কোম্পানীর প্রাইস সেনসিটিভিটি তথা শেয়ারমূল্য উঠানামার তুলনামূলক চিত্র। কম্পিউটারে কোন কোম্পানীর প্রাইস চার্ট এর সাথে ডিএসই ইন্ডেক্স চার্ট মিলিয়ে যে কোন কোম্পানীর β এর মান বের করা যায়। β এর মান ১ এর নীচে থাকার অর্থ হচ্ছে ইন্ডেক্স যে হারে বাড়ছে বা কমছে তার চেয়ে কম হারে ঐ কোম্পানীর শেয়ারের দাম বাড়ছে বা কমছে। এটির মান যত কম, শেয়ারটি ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় ততটাই নিরাপদ। ডাউন মার্কেটে এবং রক্ষনশীল সতর্ক বিনিয়োগকারীদের জন্য এটির মান ১ এর নীচে থাকা আবশ্যক। করোনা ভাইরাস পরবর্তী সম্ভাব্য মন্দা অর্থনৈতিক অবস্থা্য়, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে শেয়ার মার্কেট ডাউন থাকার আশংকা রয়েছে, ঝুকিপূর্ণ কোম্পানীর শেয়ার এড়িয়ে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
(৬) পরিশেষে বলা যায় যে শুধুমাত্র যৌক্তিক দরে শেয়ার ক্রয় করতে হবে। একটা কোম্পানী তা যত ভালই হোক আর তার আর্নিংস যত আকর্ষনীয়ই হোক, দাম বৃদ্ধিরও একটা যৌক্তিক সীমা আছে। সেরুপ সীমার মধ্যে দাম থাকলেই শুধু সেখানে বিনিয়োগের চিন্তা করা উচিত। কারণ বাজারমূল্য যতই হোক কোম্পানী ল্ভ্যাংশ দিবে ফেসভ্যালুর উপর ভিত্তি করে এবং দাম যত বেশী হবে ডিভিডেন্ড ইল্ড (Dividend Yield) ততই কমবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে রেকিট বেনকিজার ১২৫০% ডিভিডেন্ড দিলেও ঘোষনাকালীন সময়ে কোম্পানীর বাজারদর ৩১৩০ টাকা বিবেচনায় ডিভিডেন্ড ইল্ড হবে মাত্র ৪%। তাছাড়া, শেয়ার মার্কেটের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে Price Volatality। আজ যে দাম আছে নানাবিধ কারণে আগামীকাল তার দাম পড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কম দামে শেয়ারটি কেনা সম্ভব হলে মার্জিন অব সেফটি বাড়বে যা ঝুঁকি কমাবে।
পরিশেষে বলবো যে, শেয়ার মার্কেটে যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, বিনিয়োগকারীগণ যদি সতর্ক থেকে এবং কোম্পানীভেদে ঝুঁকির মাত্রা সঠিকভাবে পরিমাপ করে সঠিক দামে শেয়ার কিনতে পারেন তবে তাঁরা কঠিন প্রতি্যোগীতামূলক শেয়ার মার্কেটে টিকে থাকতে পারবেন এবং তার মাধ্যমে নিজেদের ইপ্সিত আর্থিক সাফল্য লাভ করবেন।
শফিকুল ইসলাম : অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল)
ইমেল: msislam201386@gmail.com