ত্রিদেশীয় বাণিজ্যের সম্ভাবনা রহনপুর স্টেশনকে ঘিরে

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৮-৩০ ০৯:৪৭:৩০


সম্প্রতি বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে সংশোধিত ট্রানজিট চুক্তি অনুমোদিত হওয়ায় নেপাল-বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ত্রিদেশীয় বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আর এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর রেল স্টেশনটি। মংলা বন্দর হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ও ভারতের সিঙ্গাবাদ রেলপথ ব্যবহার করে নেপালে পণ্য আমদানি-রফতানি শুরু হবে শিগগিরই। বর্তমানে শুধু বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রহনপুর স্টেশনটির অবকাঠামো উন্নয়ন না হলে সুফল মিলবে না এই ট্রানজিটের।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে নেপালের সঙ্গে থাকা সংশোধিত ট্রানজিট চুক্তি অনুমোদিত হয়। ইতোপূর্বে নেপাল রহনপুর রেলপথ দিয়ে মংলা বন্দরে আমদানিকৃত সার পরিবহন করেছে। এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত রহনপুর রেল স্টেশন পরিদর্শন করে এই পথ দিয়ে তারা নেপালের সীমান্তবর্তী স্টেশন বীরগঞ্জ ও রক্সাল পর্যন্ত রেলে পণ্য পরিবহন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

খরচ কম হওয়ায় আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ তথা আমদানি-রফতানিকৃত পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর রেলওয়ে শুল্ক স্টেশনটি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ঢাকা ও কলকাতার সঙ্গে রেল যোগাযোগের মাধ্যমও ছিল এই রহনপুর-সিঙ্গাবাদ রেলপথটি। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পরে এই রেলপথটি শুধু পণ্য আমদানি-রফতানির জন্যই ব্যবহৃত হয়। আর দূরত্ব কম হওয়ায় ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমও এই রেলপথ। ২০০৮ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী রহনপুর রেল স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করার ঘোষণা দিলেও; এখন পর্যন্ত তা ঘোষণাই রয়ে গেছে।

সরেজমিনে বাংলাদেশ-ভারতের জিরো পয়েন্ট শিবরামপুরে কথা হয় রেল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের সঙ্গে। তারা জানান, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রহনপুর রেল স্টেশন থেকে ভারতের সীমান্তবর্তী স্টেশন সিঙ্গাবাদের দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। এরপরই ভারতের সিঙ্গাবাদ হয়ে ২১৭ কিলোমিটার পরেই নেপালের বীরগঞ্জ স্টেশন। ভারত তাদের রেলপথ ব্যবহারে সম্মতি দেওয়ায়, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আলোর মুখ দেখবে বাংলাদেশ-নেপাল বৈদেশিক বাণিজ্য। আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালু থাকায় দেখা দিয়েছে ত্রিদেশীয় বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা।

স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা আশরাফুল ইসলাম আশরাফ জানান, ‘রহনপুর রেল স্টেশনে রেলওয়ের পর্যাপ্ত জায়গা থাকলেও; এটিকে পূর্ণাঙ্গ রেল বন্দরে পরিণত করতে এখানে ইর্য়াড তৈরি, রহনপুর-সিঙ্গাবাদ রেলপথের বিভিন্ন পুরনো রেলসেতু সংস্কারসহ ডাবল লাইন নির্মাণ জরুরি।’

স্থানীয় আমদানিকারক সাব্বির হোসেন জানান, ‘ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য খালাস করে সড়ক পথে দেশের বিভিন্নস্থানে নেওয়ার জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা, ওয়্যারহাউস নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত না করলে এই ট্রানজিটের সুফল পাবো না। এতে সরকার বড় ধরনের রাজস্ব হারাবে।’

ভারত থেকে ট্রেন বাংলাদেশে ঢুকছে আরেক আমদানিকারক জনি জানান, ‘নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ভারত থেকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে পারছি না। নেপালের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাইলে ডাবল লাইন নির্মাণ, ইঞ্জিন বৃদ্ধি, ব্যাংকিং সুবিধা এবং প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টি করে র‌্যাক নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন দুটি করে র‌্যাক নেওয়ার কথা থাকলেও; একটি র‌্যাকই ঠিকমতো প্রতিদিন নিতে পারি না। আবার ইঞ্জিন সংকটের কারণে সেই পণ্য সময়মতো ডেলিভারিও দিতে পারি না। এতে আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

এই বন্দর ব্যবহারকারী আরেক ব্যবসায়ী জুয়েল রানা জানান, ‘ভারতের ওপারে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার পরও; ওভার একসেপ্টেশন করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। যার ফলে সাপ্লাই চেনের যে টাইমিং থাকে সে টাইমিং থেকে পিছিয়ে পড়ছে এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এর মূল কারণই হচ্ছে রেলের ইঞ্জিন সংকট।’

ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ যৌথ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ‘মংলা বন্দর ও এই স্টেশন ব্যবহার করলে নেপালের সময় ও খরচ কম হবে। তবে এই ট্রানজিট চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জরুরি প্রয়োজন রহনপুর রেলওয়ে শুল্ক স্টেশনকে বন্দরে রপান্তর করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, কাস্টমসের বিভিন্ন দফতর ও কর্মকর্তা নিয়োগ, ব্যাংকিং সুবিধা সৃষ্টি, পর্যাপ্ত রেলওয়ে ইঞ্জিন সরবরাহ নিশ্চিত করা। তাহলে সরকার এখান থেকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাবে। পাশাপাশি ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’

এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউর রহমান ও গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস জানান, এই রেল স্টেশনটিকে পূর্ণাঙ্গ রেল বন্দরে পরিণত এবং সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দ্রুত একটি সার্ভে টিম পাঠিয়ে জরিপ করা জ্বরুরি। তাদের মতামত অনুযায়ী এই রেল স্টেশনের উন্নয়ন প্রয়োজন।

এই স্টেশনটির অপার সম্ভাবনা থাকার পরও যথাযথ সংস্কারের অভাবে, চলমান ভারত-বাংলাদেশ আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে অর্জিত হচ্ছে না রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা। গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৪২ কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা।

রহনপুর রেল স্টেশন মাস্টার মির্জা কামরুল হক বলেন, ‘এই পথ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা আগে থেকেই ছিল। নতুন করে নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট যোগ হওয়ায় এই সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল। ইঞ্জিন ও ইয়ার্ড সংকটের কারণে প্রতিদিন দুটি করে র‌্যাক ভারত থেকে নেওয়ার কথা থাকলেও; তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া রেলের দখলকৃত জমি উদ্ধার করে রহনপুর রেল স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ রেল বন্দরে রুপ দেওয়া জরুরি। এটি করা গেলে রাজস্ব আয়ের নতুন এক বিশেষ কেন্দ্র হতে পারে রহনপুর রেল স্টেশন।’