ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে ২৪৬ কোটি টাকা

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৯-২০ ১৭:২৩:২১


মা ইলিশ এবং জাটকা সংরক্ষন করা ও দরিদ্র জেলেদের বিকল্প উপায়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে এর প্রক্রিয়াকরণ শেষ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) যেকোনো সময় এটি উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদন পেলে দেশের ২৯টি জেলার ১৩৪টি উপজেলায় চলতি বছর থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে মৎস্য অধিদফতর।

তবে এরই মধ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ভ্রমণ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে ১৭৪ জন কর্মকর্তার ভ্রমণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৯৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা। যা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তবে এই ভ্রমণ দেশে না বিদেশে সেটি উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সম্প্রতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে হোক আর বিদেশে হোক, প্রয়োজন হলে কর্মকর্তারা ভ্রমণ করবেন। আমরা ভ্রমণের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেসব প্রস্তাব আসছে সেগুলো ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না। অহেতুক ভ্রমণের নামে অর্থ অপচয় কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমার পক্ষে প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা উল্টে দেখা সম্ভব হয় না। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা (সচিব) অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তারা প্রস্তাবের সবকিছু দেখে এবং মূল্যায়ন করেই একনেক উপস্থাপনের জন্য সুপারিশ করে থাকেন। তারপরও যদি অপচয়ের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে প্রকল্প বাস্তবায়নের যেকোনো পর্যায়েই হস্তক্ষেপ করা হবে।’

এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের উপপরিচালক (অর্থও পরিকল্পনা) হাসান আহম্মেদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এসব ভ্রমণ বিদেশে নয়, দেশের ভেতরেই হবে। এজন্য যতটা সম্ভব ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটি ২৯টি জেলার ১৩৪টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হবে। মাঠ পর্যায়ে সার্ভিলেন্স টিম কাজ করবে। বিশেষ করে জাটকা মৌসুম ও মা ইলিশ মৌসুমে সার্ভিলেন্স টিমকে বেশি কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবসময় চেষ্টা করি সরকারের রাজস্ব থেকে আয় করা অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে।’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় ও আমিষ সরবরাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ এবং জিডিপিতে অবদান এক শতাংশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার প্রধান উৎস্য হচ্ছে ইলিশ। প্রায় ৫ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। সারাবিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশ আহরিত হয় এ দেশের নদ-নদী থেকে। আশির দশকের আগে মোট মৎস্য উৎপাদনের ২০ শতাংশ ছিল ইলিশের অবদান। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে ইলিশের উৎপাদন আশির দশকের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এর অন্যতম কারণ হলো অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে বিশেষ করে নদ নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ ও কালভার্ট ব্রিজ নির্মাণের কারণে এবং উজান হতে পরিবাহিত পলি জমার জন্য পানি প্রবাহ ও নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় জলজ পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ছে। ফলে ইলিশ মাছের পরিভ্রমণ পথ, প্রজনন ক্ষেত্র, বিচরণ ও চারণক্ষেত্র দিন দিন পরিবর্তিত ও বিনষ্ট হচ্ছে।

তাছাড়া নির্বিচারে অবৈধ কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল, বেড় জাল, চড় ঘড়া জাল, মশারি জাল, পাইজাল এবং সরঞ্জাম দিয়ে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণও ইলিশের উৎপাদন হ্রাসের অন্যতম কারণ। এসব ক্ষতিকর অবৈধ জাল ও সরঞ্জাম নির্মূল করা না গেলে ইলিশের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। তাই জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণের মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করাকে প্রস্তাবিত প্রকল্পের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

ইলিশ সম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ নদী, মাছবাজার, মাছঘাট, হাট, আড়ৎ ইত্যাদি জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা অপরিহার্য। প্রস্তাবিত প্রকল্পে জাটকা ধরা নিষিদ্ধ সময়ে এবং জেলেদের অবৈধ মাছ ধরা বন্ধে বিভিন্ন ধরনের কম্বিং অপারেশন, ক্রাশ প্রোগ্রাম এবং অভিযান পরিচালনার সংস্থান রাখা হয়েছে। তাছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে ইরিশের অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং অভয়াশ্রম সংলগ্ন ১৫৪টি ইউনিয়নে মেয়াদে মোট ১ হাজার ২৩২টি সচেতনতামূলক সভার আয়োজন রাখা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণকারী ৩০ হাজার জেলে পরিবারের দক্ষতা বাড়ালে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে উপকূলীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের অধিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন হবে। এসব বিবেচনা করে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ওপর গত ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় দেওয়া সুপারিশ গুলোর অন্যতম হচ্ছে, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে জেলে প্রতি ২৫ হাজার টাকা নগদ প্রদানের পরিবর্তে স্থানীয় চাহিদার জন্য সমপরিমাণ টাকার উপকরণ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে ও প্রশিক্ষণার্থীদের মোবাইল নম্বরসহ ডাটাবেজ সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে উপকরণের বিবরণ ও পরিমাণ, উপকরণভিত্তিক প্রশিক্ষণের ট্রেড নির্ধারণ, প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল, প্রশিক্ষণ কারিকুলাম, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদির তথ্যাদি ডিপিপিতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

এছাড়া অবৈধ কারেন্ট জাল ধ্বংস করে জেলেদের মৎস্যবান্ধব জাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জালের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া জালের নাম ব্যাস, সূতার মান সুনির্দিষ্টভাবে ডিপিপিতে উল্লেখ করতে হবে। প্রকল্পের আওতায় নিখোঁজ ৫০ জন জেলের পরিবারের জন্য এক লাখ করে আর্থিক সহায়তা প্রদান আইটেমটি প্রকল্প থেকে বাবদ দিতে হবে। শুধুমাত্র মা ইলিশ সংরক্ষণের নদী, মোহনা, মাছঘাট, আড়ত ইত্যাদিতে ২২ দিনের অভিযান পরিচালনার জন্য অভিযান প্রতি ৫ হাজার টাকার সংস্থান ডিপিপিতে রেখে এ আইটেমের ব্যয় কমিয়ে প্রাক্কলন করা যেতে পারে।

পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ৬০ হাজার পোস্টারর ছাপানোর জন্য পোস্টারপ্রতি ৫০ টাকা হারে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ের সংস্থান বাজার দর যাচাই করে যৌক্তিক করতে হবে। নোট বুক প্রস্তুত বাবদ প্রাক্কলিত ৪০ লাখ টাকা ডিপিপি থেকে বাদ দিতে হবে। এছাড়া প্রকল্প থেকে বাদা দিতে হবে আওতায় ২ কোটি ১৭ লাখ ৮ হাজার টাকার প্রাক্কলিত বিলবোর্ড স্থাপন আইটেমটি। প্রকল্পের আওতায় জেলেদের আইডি কার্ড হালনাগাদকরণ আইটেমটি বাদ দিতে হবে। আর বাদ দিতে হবে মৎস্য মেলা।

এ বিষয়ে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লীপ্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ইলিশের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণ হওয়ার পাশাপাশি ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়বে ও উপকূলীয় জেলেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। তাই প্রকল্পটি অনুমোদনযোগ্য।’