উচ্চঝুঁকিতে এস আলমের সব ব্যাংক
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০২৪-০৮-১৬ ০৮:৫৭:৫৬
ইসলামী ব্যাংকসহ আরও ছয়টি ব্যাংক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে লুটপাট করে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনৈতিক সুবিধা বন্ধ হওয়ায় উচ্চঝুঁকিতে পড়েছে গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলো। সদ্য বিদায়ী আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একাধিক ব্যাংক দখল করার অভিযোগ রয়েছে। ঋণের নামে অর্থ পাচার করে ডুবিয়েছে এসব ব্যাংক।
এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে দেশের প্রথম শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ পদে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়োগ করা হয়। এ কারণে গ্রুপটির পক্ষে উল্লেখযোগ্য ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
বির্তকিত এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ টাকা বানানোর এক অনন্য উপায় আবিষ্কার করেছেন। তার টাকা তৈরির কৌশলের অন্যতম হলো নতুন কোম্পানি তৈরি বা রুগ্ণ কোম্পানি অধিগ্রহণ করা এবং তারপর এসব কাগুজে কোম্পানির নামে শত কোটি টাকার ঋণ নেওয়া।
মাসুদের আত্মবিশ্বাস রয়েছে, কোনো ব্যাংক তাকে প্রশ্ন করার সাহস করবে না। কারণ অনেক ব্যাংকই তার নিয়ন্ত্রণে। এর জন্য তিনি কৌশলে নিজের লোকদের বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এসব কোম্পানি তার আত্মীয় বা অন্য ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত।
এরকম একটি উদাহরণ হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে গ্রুপটির প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করা। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১৮ কোটি টাকায় মাসুদ সিলভার ফুডস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামক একটি রুগ্ণ ময়দার কারখানা অধিগ্রহণ করেছিলেন। ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল ইসলামী ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখা এ কারখানার জন্য ৮৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে।
এদিকে ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়াতে ব্যাংকগুলো প্রায় দুই বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। যদিও সদ্য পদত্যাগ করা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছিলেন।
সূত্র জানায়, পলাতক সদ্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোপনে অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে এস আলমের ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। সরকারে পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংককে দেওয়া বিশেষ সুবিধার সীমা কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি এসব ব্যাংকের এক কোটি টাকার বেশি অর্থের চেক ক্লিয়ারিং করার সুবিধাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সদ্য নিয়োগ পাওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এসব ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। এখন ব্যাংকটির এক-তৃতীয়াংশ ঋণই গ্রুপটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট। একই বছরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় দখল করে এস আলম গ্রুপ। আগের বছর তারা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এস আলম গ্রুপের হাতে। আর ২০০৪ সালে সিকদার গ্রুপ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যায় এস আলম গ্রুপের কাছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ২০১৭ সালে ব্যাংকটি দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ হচ্ছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা। যখন মালিকানা পরিবর্তন হয়, তখন ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের বড় অংশই এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) ও ইউনিয়ন ব্যাংক। কিছুদিন পর গ্লোবাল ইসলামীতে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে। এই দুই ব্যাংক যা ঋণ দিয়েছে, তার বেশির ভাগই ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব ঋণ এস আলম গ্রুপের বলেই জানিয়েছেন ব্যাংক দুটির ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে ইউনিয়ন ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানায়, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত ঋণ বিতরণ করেছে, তার সিংহভাগই খেলাপি বা অনিয়মযোগ্য। পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এখন ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা।
রুগ্ণ ফার্স্ট সিকিউরিটি ও কমার্স ব্যাংক: ২০০৪ সালে সিকদার গ্রুপ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যায় এস আলম গ্রুপের কাছে। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম নিজেই। নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ব্যাংকটিকে ইসলামি ধারার ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। ব্যাংকটির ঋণ প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, ঋণের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ার কিনে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তাঁর পরিবারের এক সদস্যকে ওই ব্যাংকের পরিচালক করা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সেই শেয়ার হস্তান্তর হয়েছে, কিন্তু ঋণ শোধ হয়নি। বছরের পর বছর এসব ঋণ আদায় না হলেও খেলাপি দেখানো হয় না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে সিআরআরসহ ৭ আগস্ট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির অনিয়ম প্রকট হওয়ায় গত বছর ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
কোন ব্যাংকের কত ঋণাত্মক: ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে ১০ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ঘাটতি ৭ হাজার ১২৮ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪ হাজার ৪৮১ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৭৯৪ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৭১২ কোটি এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৩৯২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী ব্যাংকসহ ৭টি ব্যাংকের ওপর এস আলম গ্রুপের এমন নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের নজির বিশ্বের কোথাও নেই।
অস্তিত্বহীন কিংবা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে হাজার কোটি ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে বোঝা যায়, নানা অনিয়ম জেঁকে বসেছে। ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৪০-৪৫ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। এ টাকা ফেরত আনা জরুরি।
এম জি