কমছে আয়, প্রিন্ট মিডিয়ার করণীয় কি?
প্রকাশ: ২০১৬-১০-২৬ ১৩:১০:২৩
প্রিন্ট মিডিয়ার রমরমা অবস্থাটি আর নেই। ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে প্রিন্ট মিডিয়ার এখন পড়তি দশা। বিশ্বজুড়ে ছাপানো পত্রিকার আয় ক্রমশ কমছে। আর সে জায়গাটি দখল করে নিচ্ছে ডিজিটাল বা অনলাইন মিডিয়া। তাহলে উপায়? সে উপায় খুঁজে বের করার জন্য গত সপ্তাহে দুনিয়ার বাঘা নিউজ পাবলিশাররা বসেছিলেন করণীয় ঠিক করতে। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে ডিজিটাল মিডিয়ায় শিফট করবেন কিনা, এ নিয়ে গলদঘর্ম হয়েছেন তারা। মিডিয়া মোগলরা শেষমেষ অনিচ্ছাসত্ত্বেও একমত হয়েছেন, প্রিন্ট মিডিয়ার স্বর্ণযুগ এখন কেবলই অতীতের ঘটনা —‘the glory days of newsprint are long behind us.’
মিডিয়া ব্রিফিং নামের একটি স্বনামধন্য ডেইলি নিউজলেটারে এ নিয়ে একটি সারগর্ভ প্রতিবেদন লিখেছেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস সাটক্লিফে (Chris Sutcliffe)। ‘What can newspapers do in the face of falling print revenue?’ শিরোনামে ২৪ অক্টোবর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের প্রথম বাক্যটিতেই তিনি প্রিন্ট মিডিয়ার মরণদশার ইঙ্গিত দিয়েছেন: ‘The writing’s on the wall for print revenue’।
তার অভিমত, পাবলিশিং স্ট্রাটেজিতে প্রিন্ট মিডিয়ার অবদান রাখার সুযোগ আর তেমন নেই। কেননা প্রিন্ট মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের আয় দিনকে দিন কমে আসছে। পাবলিশাররা প্রিন্ট-স্টাইল-রেভিনিউর স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার জন্য যতো কৌশলেরই দ্বারস্থ হোন না কেন, সেটি আর আগের অবস্থায় ফিরবে না।
প্রিন্ট মিডিয়ার এই বেহাল দশার কারণে কি সাংবাদিকতার মান পড়ে যাবে? সাটক্লিফে তা মোটেই মনে করেন না। তার ভাষায় ‘Nor is to say that the quality of journalism will be degraded by the decline. এ অবস্থায় তিনি একটি ‘শত কোটি ডলারের প্রশ্ন’ ( the billion dollar question) ছুড়ে দিয়েছেন: ‘ছাপানো সংবাদপত্রের প্রকাশকরা তাদের প্রিন্ট প্রোপার্টি নিয়ে এখন কি করবেন? ’
সাটক্লিফে লিখেছেন, আটলান্টিকের দু’পাড়ের ছাপানো সংবাদপত্রগুলোর বহু মালিক/প্রকাশকের জন্য এটি ছিল এক বাজে সপ্তাহ। আর্থিক ফলাফলটা তাদের জন্য ছিল হতাশাজনক। তাদের সামনে বিজ্ঞাপনের পূর্বাভাসটা মোটেই সুখকর নয়। The Wall Street Journal পত্রিকার সুজানা ভ্রানসিয়া ও জ্যাক মার্শাল (Suzanna Vrancia and Jack Marshall) এরই একটা সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। তারা লিখেছেন, বিশ্বব্যাপী ছাপানো পত্রিকার বিজ্ঞাপনের আয় চলতি ২০১৬ সালে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কমে ৫২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। ২০০৯ সালের মন্দার পর এতোটা খারাপ অবস্থা প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য আর আসেনি। মন্দার ওই সময়টায় বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের আয় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছিল।
এছাড়া ‘Print advertising woes are getting worse’, শিরোনামের এক নিবন্ধে সাংবাদিক রিক এডমন্ডস (Rick Edmonds) লিখেছেন, যেসব দেশে ছাপানো পত্রিকা এখনও ভালো অবস্থায় আছে, সেখানেও বিজ্ঞাপনের আয়টা সুখকর নয়—‘it looks like global print ad spending isn’t exactly in the best of health’
‘আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ছাপানো সংবাদপত্রগুলোর ওপর বিশেষ আলোকপাত করেই ওই প্রতিবেদনে এমন হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।এখনো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছাপানো পত্রিকা তাদের অবস্থান ধরে রাখলেও অবস্থা সেখানেও আর আগের মতো নেই। যেটুকু আছে সেটাও থাকবে না।
যারা সাংবাদিকতার পেশায় জড়িত তাদেরও বিষয়টি নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন সাটক্লিফে। কেননা এরই মধ্যে অনেক প্রকাশকের টনক নড়েছে। তারা বিজ্ঞাপনদাতাদের মন কাড়ার জন্য ডিজিটাল অডিয়েন্সের মূল্য তুলে ধরতে মরিয়া। অ্যাড ফরম্যাটেও তারা পরিবর্তন আনছেন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক the Independent পত্রিকার প্রকাশকরা তাদের প্রিন্ট এডিশন বাদ দিয়ে গত ২৩ বছরে এই প্রথমবার কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পেয়েছেন —‘returned to profitability for the first time in twenty three years as a result of abandoning its print edition.’
পত্রিকাটির মালিক ইয়েভগেনি লিয়েবেদেভ (Evgeny Lebedev) ডিজিটাল সংস্করণের দিকে যাওয়ার যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিজেই নিয়েছিলেন। তার ধারণা অন্যসব ছাপানো পত্রিকার মালিক/ প্রকাশকরাও অদূর ভবিষ্যতে তার পথেই হাঁটবেন। তার যুক্তি:”By going online-only we freed ourselves from the unwieldy infrastructure of print, and allowed ourselves to be far more flexible.’
‘যদিও এখন সবে শুরু, তথাপি প্রথম ৬ মাসে দেখা গেছে যে, দ্রুত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে, ডিজিটালি ফোকাসড হয়ে আমরা আমাদের নতুন ও বৃহত্তর অনলাইন পাঠকগোষ্ঠীকে আরও উত্তম সেবা দিতে পারি।’
ইয়েভগেনি লিয়েবেদেভ আরও বলেছেন, ছাপানো পত্রিকা বিলি করা, পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়াটাও এক মহা ঝক্কির ব্যাপার। বিজ্ঞাপন যখন কমে আসছে, তখন পত্রিকা বিলি করার খরচ সামাল দেওয়াটাও হয়ে উঠছে কষ্টকর। সে অসুবিধা অনলাইনে একদমই নেই।
তিনি মনে করেন, ৫ লাখ কপি পত্রিকা ছাপানো হলে বিজ্ঞাপনের আয় ১৬ শতাংশ কমে যাবে। ছাপানোর ব্যয় কিন্তু ১৬ শতাংশ কমবে না। এক্ষেত্রে পত্রিকা ছাপানোর সংখ্যা ৫ লাখ কপি থেকে কমিয়ে ১ লাখ বা বড় জোর আড়াই লাখ কপিতে নামিয়ে আনলে লোকসান কিছুটা হয়তো কমানো যাবে।
এসব তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটেনে পত্রিকা মালিকদের অনেকেই প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করে দিয়েছেন। অবশ্য এখনো অনেক প্রকাশক প্রিন্ট ভার্সন ছাপানো পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে রাজি নন। তারা মধ্যপন্থা ধরে চলার পক্ষে। তারা মনে করেন: there is a potential middle ground.
কিন্তু এই মধ্যপন্থাও বেশিদিন ধোপে টিকবে না। আজকের এই ডিজিটাল দুনিয়ায় ছাপানো পত্রিকার দিন ফুরিয়ে আসছে, বন্ধ হয়ে আসছে আয়ের পথ, সংকুচিত হয়ে আসছে এর আবেদন। উপায় একটাই- নিজেকে বদলে ফেলে ডিজিটাল বা অনলাইনের পাল ওড়ানো। তাহলে সাপও মরবে আর লাঠিও থাকবে অক্ষত।
‘The writing’s on the wall for print revenue’—সাটক্লিফের এই ভাষ্যই বলছে, দেয়ালের লিখনটা প্রিন্ট মিডিয়া ওয়ালারা যত তাড়াতাড়ি পড়বেন ততই মঙ্গল।