স্কয়ার ফার্মার ডিভিডেন্ড, শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য সুযোগ কাজে লাগানো

:: আপডেট: ২০২১-১১-২২ ২৩:১২:৫৫


সারা দুনিয়াতেই শেয়ার মার্কেটে দামের উত্থান-পতনে মার্কেট খেলোয়াড়দের আস্থা, বিশ্বাস ও আবেগের যথেষ্ট ভূমিকা থাকে। তালিকাভূক্ত কোন কোম্পানীর ভাল-মন্দ যে কোন নিউজে তার প্রতিফলন ঘটে থাকে। অনেক সময়ই সেসব নিউজ বা ঘোষনাকে কেন্দ্র করে আবেগের আতিশয্যে শেয়ার প্রাইসের মাত্রাতিরিক্ত উঠা-নামা করতে দেখা যায়। যে মার্কেট যত বেশী অপরিণত সেখানে আবেগের প্রকাশ তত বেশী হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায় অপরিণত এবং বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা ও প্রত্যাশা একটু ভিন্নতর বিধায় সেখানে আবেগের আতিশয্য যে পর্যায়ে সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও তা দেখা যাবে না। এরুপ অতিরিক্ত আবেগের ফলে এখানে ঝুঁকির পরিমাণ যেমন বেশী লাভের সম্ভাবনাও তেমনি বেশী।

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের S&P 500 ইন্ডেক্সে বিনিয়োগ করে ১৯২৬ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বার্ষিক রিটার্ন পাওয়া গেছে গড়ে ১০% যেখানে ঝুঁকির মাত্রা ছিল প্রায় ১৮%। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড় রিটার্ন ছিল প্রায় ১৩.২৫% যেখানে ঝুঁকির মাত্রা ছিল ৩২%, যা আমেরিকার থেকে উভয় ক্ষেত্রেই অনেকটা বেশী। তাই বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে অন্যদের অপ্রত্যাশিত ও অনেকক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় আবেগকে আপনি কাজে লাগিয়ে লাভবান হতে পারেন। এরুপ লাভবান হওয়া কিংবা নিদেনপক্ষে লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি করা থেকে বাঁচার উত্তম উদাহরণ হতে পারে সাম্পতিক সময়ে স্কয়ার ফার্মার ডিভিডেন্ড ঘোষনা এবং তাকে ঘিরে বিনিয়োগকারীদের আচরণ। সে বিষয় নিয়েই এ নিবন্ধ।

বাংলাদেশের মার্কেটে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীটি দীর্ঘদিন ধরেই অন্যতম মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন ভাল কোম্পানী হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ কোম্পানীর সার্বিক ব্যবসার পরিমাণ, মোট আয়, ইপিএস, ডিভিডেন্ড, ইত্যাদি সময়ের সাথে সাথে ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। অন্যান্য সব সূচকও পজিটিভ বলা চলে। তবে কোম্পানীর পেইড আপ ক্যাপিটাল বেশী হওয়া এবং উদ্যোক্তারা মার্কেট ম্যানিপুলেশনের সাথে জড়িত না থাকার কারণে শেয়ারটির দাম তেমন বৃদ্ধি পায় না বলে অনেকেরই ধারণা। যাহোক, বিগত ৫ বছরে কোম্পানীর ডিভিডেন্ড পরিমাণ নিম্নরুপঃ ২০২১ সালে ৬০% (শুধু ক্যাশ), ২০২০ সালে ৫২% (৪৭% ক্যাশ ও ৫% স্টক), ২০১৯ সালে ৪৯% (৪২% ক্যাশ ও ৭% স্টক), ২০১৮ সালে ৪৩% (৩৬% ক্যাশ ও ৭% স্টক) এবং ২০১৭ সালে ৪২.৫% (৩৫% ক্যাশ ও ৭.৫% স্টক)। বিগত ২৪ অক্টোবর ২০২১ তারিখে কোম্পানীর পরিচালকমন্ডলীর ৬০% ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষনা বিনিয়োগকারীদের মোটেই মনপূত হয় নাই। বার্ষিক ইপিএস ১৭.৯৯ টাকার বিপরীতে শেয়ারপ্রতি ডিভিডেন্ড মাত্র ৬ টাকা এবং পে-আউট রেশিও মাত্র ৩৩.৩৩% যা সত্যিই কম। তাই বিনিয়োগকারীদের হতাশ হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ছিল বটে। কিন্ত সে হতাশাজনিত অবস্থার প্রকাশ ছিল অতিরঞ্জিত। ডিভিডেন্ড ঘোষনার দিনের ওপেনিং প্রাইস ২৩১ টাকা থেকে ক্রমাগতভাবে প্রতিদিন দাম পড়ে গেছে এবং বিগত ৮ নভেম্বর তারিখে তা ২০৯ টাকায় নেমে আসে। বলা যায় ডিভিডেন্ড ঘোষনার পর প্রায় ১০% দরপতন হয়। কোম্পানীর পরিচালনা পর্যদ ইপিএস এর অন্তত ৫০% পে-আউট শেয়ারহোল্ডারদের দিতে পারতেন। সেক্ষেত্রে ৯০% ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদান করা যথার্থ ছিল।

ডিভিডেন্ড ঘোষনার পর শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিক্রিয়া কেন অতিরঞ্জিত ছিল সে ব্যাখ্যাতে যাই। শেয়ারহোল্ডাররা সম্ভবত ক্যাশ ডিভিডেন্ড এর সাথে অতিরিক্ত কিছু স্টক ডিভিডেন্ড প্রত্যাশা করেছিল। যদি ৫% স্টক দেয়া হতো এবং পোষ্ট-রেকর্ড ডেট এ প্রাইস ২০০ টাকায় নেমে এলেও তারা (ক্যাশ ডিভিডেন্ড এর অতিরিক্ত) ৫% স্টক ডিভিডেন্ড বাবদ ১০ টাকার সমপরিমাণ লাভ পেতেন। কিন্ত সে প্রত্যাশা পুরণ না হলেও খুব ক্ষতি কিন্ত হয়নি। এ মূহুর্তে শেয়ারহোল্ডাররা লাভ কম পেলেও ভবিষ্যতে তা নিশ্চিতভাবেই পুষিয়ে যাবে।

কারণ পে-আউট অর্থাৎ ডিভিডেন্ড দেয়ার পর অবশিষ্ট লাভ কিন্ত কোম্পানীর হিসাবে রিটেইনড ইনকাম হিসাবে থেকে যাবে। আর স্টক ডিভিডেন্ড না দেয়ার কারণে শেয়ারসংখ্যা আর না বাড়ার ফলে আগামীতে ইপিএস প্রবৃদ্ধির হার বেশী হবে বলে আশা করা যায়। স্কয়ার ফার্মার বিরুদ্ধে নিকট অতীতে অন্যতম অভিযোগ ছিল যে তারা প্রতিবছর স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষনার মাধ্যমে মোট শেয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে, যার ফলে কোম্পানীর আয় অনেক বাড়লেও ইপিএস তেমন বাড়ছে না। এটি বাস্তব সত্য যে বিগত ২০০২ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে কোম্পানীটি প্রতি বছর ক্যাশ ডিভিডেন্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন হারে (৫% থেকে ৫০% পর্যন্ত) স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছে। সে বৃত্ত থেকে কোম্পানী এবার বেরিয়ে এসেছে, তবে উদ্যোক্তারা পে-আউট অপ্রত্যাশিতভাবে কম ঘোষনার মাধ্যমে রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। এতে করে এখনকার শেয়ারহোল্ডাররা লাভ কম পেলেন, যদিও তার সুফল পাবেন আগামী দিনের শেয়ারহোল্ডাররা।

অনেক সময়ই দেখা যায় যে সাময়িক আবেগ দীর্ঘদিন বজায় থাকে না। আজ কারো সম্বন্ধে যে অনুরাগ কিংবা বিরাগ তা কয়েকদিন পরেই বিপরীত রূপ নিয়ে থাকে। স্কয়ার ফার্মার প্রাইসের ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটেছে। উপরের চিত্রে স্কয়ার ফার্মা কোম্পানীর দৈনিক প্রাইস চার্টে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে অতি আবেগের ফলে ঘোষনা-উত্তর ১০% দরপতন হওয়া সত্বেও কয়েকদিন পরে প্রাইস অনেকটাই রিকভার করে। ফলে রেকর্ড ডেট অর্থাৎ ২২ নভেম্বর তারিখের পূর্বে দরপতন ছিল ঘোষনা-পুর্ব সময়ের তুলনায় মাত্র ৩% এর মত কম। যিনি হুজুগে পড়ে বা অতিরিক্ত ভীতির ফলে ধৈয্য হারিয়ে ১০% লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার জন্য সেটা হয়েছে আফসোসের বিষয়, আর যিনি প্রাইস অনেকখানি পড়ার পর নতুন করে কোম্পানীর শেয়ার কিনেছেন তার জন্য বিষয়টা আনন্দের।

ক্যাপিটাল মার্কেটে বড় শ্ত্রু হচ্ছে নিজের আবেগ। সেই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে টেকসইভাবে লাভ (Sustainable Profit) করার জন্য আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ স্ট্র্যাটেজী। সেই স্ট্র্যাটেজীতে সময়ের সাথে সাথে টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর অনুসরণ করার গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। তার মধ্যে আবার ইচিমুকো ক্লাউড নামক একটি জাপানীজ টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর স্ট্র্যাটেজী দারুনভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই আমরা পর্যালোচনা করতে পারি যে স্কয়ার ফার্মার সাম্প্রতিক ডিভিডেন্ড ঘোষনার ফলশ্রুতিতে শেয়ারটির সাময়িক দরপতনের প্রেক্ষাপটে ইচিমুকো ক্লাউডের সত্যিকার অনুসারীরা কি করতেন বা করার ছিল।

নীচের চিত্রে স্কয়ার ফার্মার সাপ্তাহিক প্রাইস চার্টে ইচিমুকো ক্লাউড নামক ইন্ডিকেটরটি বসানো হয়েছে। ইচিমুকোর ৫টি প্রধান ইন্ডিকেটর তথা Tenken Sen (TS), Kijun Sen (KS), Chikou Span (CS), সেইসাথে Senkou Span A (SSA) ও Senkou Span B (SSB) এর সমন্বয়ে সৃষ্ট Kumo বা মেঘ তীর চিহ্নের সাহায্যে দেখানো হয়েছে। ইচিমুকো স্ট্র্যাটেজীতে শেয়ার বাই কিংবা সেল করার সময় কিছু শর্ত পুরণ হয়েছে কিনা তা দেখতে হয়। যেমন- শেয়ার তখনই সেল করতে হয় যখন (১) লিডিং বা ফিউচার ক্লাউড রেড থাকে, (২) বর্তমান প্রাইস বিদ্যমান ক্লাউডের নীচে নেমে যায়, (৩) প্রাইস TS ও KS উভয়ের নীচে থাকে এবং TS রেখা উপর থেকে KS কে ছেদ করে নীচে নেমে আসে, এবং (৪) Chikou Span (CS) ক্লাউডের নীচে চলে আসে।

ইচিমুকো স্ট্র্যাটেজী অনুসারে স্বল্পমেয়াদে যারা ট্রেড করেন তারা KSকে সাপোর্ট লাইন হিসাবে ধরতে পারেন। তবে স্ট্রং সাপোর্ট লাইন হিসাবে SSA এবং অধিকতর স্ট্রং সাপোর্ট লাইন হিসাবে SSB কে বিবেচনা করা হয়।

উপরের চিত্রে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে স্কয়ার ফার্মার ডিভিডেন্ড ঘোষনার পর দরপতন হওয়া সত্বেও লিডিং বা ফিউচার ক্লাউড রেড হয়নি- বরং তা স্ট্রং গ্রীন রয়েছে। CS এবং প্রাইসও কখনো ক্লাউডের নীচে নামেনি। তবে X পয়েন্টে TS রেখা KS এর নীচে নেমেছে। সে অবস্থা সেল ইন্ডিকেটর হলেও তা খুবই দুর্বল সেল সিগন্যাল, যেহেতু ইচিমুকোর অন্যান্য শর্তাদি পুরণ হয়নি। বক্স দ্বারা চিহ্নিত Y পয়েন্টে দাম সর্বনিম্ন থাকলেও তা SSA কিংবা SSB সাপোর্ট লাইন ভেদ করে নীচে যায়নি। তাই ইচিমুকো স্ট্র্যাটেজীর সত্যিকার অনুসরনকারীদের পক্ষে ডিভিডেন্ড-উত্তর সাময়িক প্রাইস পতনের সময় স্কয়ার ফার্মার শেয়ার সেল করার কথা নয়। তবে পূর্বে কম দামে কেনা থাকলে প্রাইস কারেকশনের সময় বিক্রি করে প্রফিট টেকিং যুক্তিসংগত বিবেচিত হতে পারে। “ আর সর্বশেষ প্রাইস মোতাবেক শেয়ারটির বাই সিগন্যাল দেখাচ্ছে”।

উপরে বর্ণিত অবস্থা প্রমাণ করে যে নিজস্ব আবেগজনিত ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ইচিমুকো ক্লাউড কিভাবে শেয়ারহোল্ডারদেরকে রক্ষা করতে পারে এবং আখেরে টেকসই লাভের পথ দেখায়। তবে সেরূপ স্ট্র্যাটেজী প্রয়োগ করতে সে সম্বন্ধে ভাল্ভাবে জানতে হবে। ইচিমুকো ক্লাউড সম্পর্কে আরো বিস্তারিভাবে জানতে সহজ ভাষায় লেখকের রচিত “মেঘের আড়ালে সূর্য্যঃ ইচিমুকো ক্লাউডে শেয়ার ট্রেডিং” শীর্ষক বইটি পড়া যেতে পারে।

শফিকুল ইসলাম,অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।
Email: msislam86@yahoo.com